বাইক্কা বিলে কুয়াশা

মৌলভীবাজার বা শ্রীমঙ্গল বলতে সবাই বোঝে চা-বাগান, লাউয়াছড়া বন, মাধবপুর লেকসহ আরও কিছু বিখ্যাত জায়গা। সেই তালিকায় বাইক্কা বিলের নাম খুব একটা আসে না। তাই চা-বাগান বলি, লাউয়াছড়া বা মাধবপুর লেক বলি—এসব জায়গায় অনেকবার যাওয়া হলেও বাইক্কা বিলে যাওয়া হয়নি কখনো।

এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। অফিস থেকে ২০ জনের একটা গ্রুপ যাব ঘুরতে, মূল উদ্দেশ্য চা-বাগান, লাউয়াছড়া বন আর মাধবপুর লেক। তবে যাদের নিয়ে যাচ্ছি, তাদের জন্য বাড়তি একটা স্পট হিসেবে বাইক্কা বিল ঠিক করলাম। এর মূল কারণ হলো, ভোরের আলো ফোটার পর আমাদের তেমন কোনো কাজ থাকবে না। তাই সময়টা কাজে লাগানোর জন্য বাইক্কা বিলের চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।

গত শীতের পড়তি  সময়ে আমরা ঢাকা থেকে রওনা দিই রাতের ট্রেনে। মধ্যরাতে নেমে যাই। আগে থেকেই একটা হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল, ভোরের আলো হাসার আগে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নামলাম আর অটোরিকশাযোগে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। অপেক্ষা ছিল ভোর হওয়ার। ফজরের আজান দেওয়ার আধা ঘণ্টা পর জিপ নিয়ে নিলাম। লালরঙা জিপের একটাতে বসতে পারে ১০ জন। তাই আমাদের লাগল দুটি গাড়ি। এই জিপ দুটি আমরা ঢাকা থেকেই বুকিং দিয়ে এসেছিলাম। এখন পর্যন্ত পরিকল্পনামাফিক সব হচ্ছিল। তাই সবাই খুশি।

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে এই বিলে পৌঁছতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো। দিনের আলো ঝাঁকি দিচ্ছে কুয়াশার চাদরের মধ্যে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি! খোলা জিপের বাতাসে কুয়াশাভেজা ঝাপটা যখন মাতাচ্ছিল আমাদের, আমরা তখন শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্যে বিমোহিত। কিছু সময় পর প্রধান সড়ক থেকে চলে এলাম ছোট এক গ্রামীণ রাস্তায়। এবার আসল দৃশ্য ধারণ শুরু।

রাস্তার দুই পাশ গাছগাছালিতে সাজানো। কুয়াশার কারণে ১০ থেকে ১২ গজ দূরে কী আছে তা দেখা যায় না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সামনে চলে আসে প্রতিটি গাছ বিচিত্র ভঙ্গিতে। পুরো রাস্তায় যেন শুধু আমরাই আছি। তাই আনন্দের এই আয়োজনের সেরাটা উপভোগ করেছি।

শেষ দিকে চোখে পড়ল কিছু লোক। তাঁরা রাস্তার দুই পাশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে ছোট ছোট গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন। ধারণা করছি, এসব মাছ বিল থেকে পাওয়া। একটু পরেই মূল শহরে চলে যাবে এসব মাছ। আমরাও আশা করছি, খুব দ্রুত পৌঁছে যাব কাঙ্ক্ষিত বাইক্কা বিলে।

অতঃপর চলে এলাম বাইক্কা বিলে। দিনের আলো পর্যাপ্ত হতো, যদি কুয়াশার ধামাকা না হতো। জমকাল কুয়াশায় হালকা আলো বেশ দেখার মতো। আমরা আসলে এটাই চাচ্ছিলাম। সংরক্ষিত এ এলাকায় যেতে হলে আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিতে হয়। তারপর ভেতরে যাওয়া! আমরা সেই মোতাবেক কাজ করলাম।

প্রথম পর্বেই রয়েছে বিশাল এক বাগান। বড় বড় গাছের ছায়া আর মাটি শুকনা পাতায় ভরা। এখানে আপনার ইচ্ছা করবেই প্রতিটি গাছের সঙ্গে হাই–হ্যালো করে সামাজিকতা রক্ষা করতে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। মজা করেই বলছি, পরেরবার গেলে এসব গাছ আমরা না চিনলেও তারা আমাদের ঠিকই চিনবে। হাসিমুখে বলবে, ‘আচ্ছা, আপনারা সেই লোকগুলো না, একবার এসে আমাদের সঙ্গে হাজারখানেক ছবি তুলেছিলেন!’

অবশ্য আমাদের এই ছবি তোলা নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা নেই। সমানে ছবি তুলেই যাচ্ছি। সঙ্গে কিছু ভিডিও নিচ্ছি। এভাবে একটু সামনে এগোতেই চলে এলাম মূল বিলে। এই বিল মৎস্যসম্পদের অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। ১৮ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ, ৮০ প্রজাতির মাছ আর ১৬০ প্রজাতির পাখি নিয়ে এই বিলের সংসার। ১০০ হেক্টরের এ এলাকায় মিলেমিশে আছে জলজ আর উভচর প্রাণী। তাদের সঙ্গ দিতে থাকে কওমি, হিজল, নয়নকারা, শাপলা, নীল পদ্মসহ আরও বেশ কিছু জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য।

আমরা যে সময়ে গিয়েছিলাম, তখন অতিথি পাখির সময়। কত পাখি যে দেখলাম! ভাগ্যিস, আমি পাখিবিশেষজ্ঞ নই, নইলে এখানে আমাকে অনেক সময় দিতে হতো। বইপুস্তকের ধারণায় বলতে পারব, এখানে মেটেমাথা চিটি, পাতিসরালি, রাজসরালি, কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঙ্গাহাঁস, গুটি ইগলের কিছু না কিছু ছিল। একই কায়দায় বলতে পারব, এখানে পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, গোবক, ধুপনিবক, রাঙাবক, শঙ্খচিল, পালাশী কুড়া ইগল ইত্যাদি পাখির রাজত্ব!

ব্যাপারটা চোখে ধারণ করতে আপনাকে উঠতে হবে ওয়াচ টাওয়ারে। আফসোসের কিছু জায়গা থাকেই। যেমন একটা ডিঙিনৌকা নিয়ে কিছু সময় বিলে কাটাতে পারলে ভালো লাগত। সময়স্বল্পতার জন্য সম্ভব হয়নি।  

তবে সেবার না হলেও পরেরবার অবশ্যই এই স্বাদ মেটাতেই হবে। সেবারের সেই ট্যুরে অন্য সব স্পটে গিয়েছি আমরা! তবে আমাদের অধিকাংশের কাছে সেরা ছিল এই বাইক্কা বিল! কুয়াশা, পাখি, বিশাল বাগান, বিলের পানি মিলে পুরো ব্যাপারই ছিল অনবদ্য! ‘পেটভরে অক্সিজেন খাওয়ার’ জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে না।

তাই এর পুরো স্বাদ নিতে চাইলে আমার মতে শীতের এ সময়ই সেরা সময় বাইক্কা বিল ঘুরতে যাওয়ার। তাই ঘুরে আসুন বাইক্কা বিল আর নিজের দেশকে জানুন অন্যভাবে।