কেশরিয়ার বিলে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে শ্বেতপদ্ম
দীর্ঘ চার দশক পর কেশরিয়ার বিলে ফুটেছে শ্বেতপদ্ম। প্রায় ৫৫ একর আয়তনের এই বিলে সর্বত্রই শোভা পাচ্ছে সাদা পদ্মফুল। সৌন্দর্যপিপাসু অনেকেই আসছেন এ ফুল দেখতে। পরিবার–পরিজন নিয়ে আসছেন কেউ কেউ। স্থানীয় লোকজনের দাবি, প্রায় চল্লিশ বছর পর এবার কেশরিয়ায় ফুটেছে শ্বেতপদ্ম। তবে একসঙ্গে এত পদ্মফুল এবারই প্রথম। দেশে বিলুপ্তপ্রায় এ ফুল এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
কেশরিয়া বিলটির অবস্থান কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নে। কেশর নামক একপ্রকার জলজ উদ্ভিদ প্রচুর জন্মাত বলে এ বিলের নাম হয় কেশরিয়ার বিল। বিলে ফুটত শালুক, শাপলা, পদ্ম, কলমি, করচ, হেলেঞ্চাসহ রংবেরঙের ফুল। এসব ফুলের সৌন্দর্য দেখে মোহিত হতো যেকোনো বয়সের মানুষ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে সে দৃশ্য। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি, জলবায়ুর পরিবর্তন ও মৎস্যজীবীদের নিষিদ্ধঘোষিত চায়না ও খেতাজাল ব্যবহারের কারণে বিলুপ্ত আজ অনেক প্রজাতির ফুল। অল্পবিস্তর কলমি ও হেলেঞ্চা দেখা গেলেও সে–ও স্বল্পসময়ের জন্য। ফলে, কেশরিয়ার বিল এখন আর আগের মতো প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানে না।
এবার কেশরিয়ায় পানি কম থাকায় মৎস্যজীবীরা জাল ফেলতে পারছেন না। বিলজুড়ে ফুটেছে শতসহস্র শ্বেতপদ্ম। দেখলে দুচোখ জুড়িয়ে যায়। একসঙ্গে এত পদ্ম দেখে এলাকাবাসীও হতবাক। বিলপাড়ের বাসিন্দা রত্নেশ্বর বর্মণ (৬৭) বলেন, ‘হায়রে হায় পদ্ম! এত পদ্ম জীবনেও দেহি নাই!’
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
পদ্মফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন বিলপাড়ে ভিড় করছেন শত শত মানুষ। দর্শনার্থীদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশি। শিশুদের নিয়েও আসছেন কেউ কেউ। নাগেশ্বরী সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র শাফিন সরকার এসেছে ছোট দুই বোন সিজদা (৫) ও শাইরাকে (৬) নিয়ে। কথা হলে সে জানায়, ‘এদের পদ্মফুল দেখাতে নিয়ে এসেছি। অবশ্য আমিও শ্বেতপদ্ম দেখছি এই প্রথম। আমি অভিভূত! বিলে এত পদ্ম ফুটেছে বিশ্বাসই হচ্ছে না!’
বিলপাড়ে ঘুরতে আসা তরুণ-তরুণীদের পদ্মফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার চেয়ে ছবি তোলার ঝোঁক বেশি। তাদের অনেকেই ফুল ছিঁড়ে গলায় পেঁচিয়ে এবং কেউ কেউ হাতে নিয়ে ছবি তুলছেন। এভাবে অবাধে ফুল ছিঁড়তে দেখে উষ্মা প্রকাশ করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। তাঁদের মতে, এভাবে ছিঁড়লে শ্বেতপদ্ম অচিরেই অস্তিত্বসংকটে পড়বে। তাই এ বিষয়ে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।
একসঙ্গে এত পদ্মফুল ফোটাকে মঙ্গলের লক্ষণ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় প্রবীণেরা। তারা মনে করেন, ফুলে-ফলে আবারও ভরবে এই দেশ। কৃষকদের থাকবে গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। হিংসা, কপটতা ও বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা পাবে স্থান।
এলাকার সচেতন মহল খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন। তারা জানান মন্নেয়ার খাল দিয়ে প্রায় বছরই প্রচুর বড় বড় কচুরিপানা বিলে প্রবেশ করে। এরা দ্রুত বংশবিস্তার করে থাকে। এবারও যদি এভাবে আসে, তাহলে কচুরিপানার চাপে পদ্মগাছ তলিয়ে যাবে। তাই, এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
শ্বেতপদ্ম Nelumbonaceae গোত্রের উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaea lotus. আদিনিবাস পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায়। এরা খালবিল, হাওর-বাঁওর ও বদ্ধ জলাশয়ে জন্মায়। কন্দের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। পাতা ও ফুল পানিতে ভাসমান থাকে। পাতা সবুজ, বড় ও গোল। সাধারণত বোঁটার ওপর খাড়ায় ফুল ধরে। ফুটন্ত ফুলে মিষ্টি সুগন্ধ থাকে।
রাতে ফুল ফোটে। দিনে রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির আগপর্যন্ত প্রস্ফুটিত থাকে। প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফুল সংকুচিত হয় এবং প্রখরতা কমে গেলে প্রস্ফুটিত হয়। বর্ষা মৌসুমে ফুল ফোটা শুরু হয় এবং থাকে হেমন্তকাল পর্যন্ত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি পবিত্র। এর ভেষজগুণও অনেক। আমাশয়, পেটের পীড়া ও ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এটি কার্যকর। বাংলা সাহিত্যে বহুবার এ ফুলের কথা উঠে এসেছে।