স্বর্ণদ্বীপের খোঁজে সোনাদিয়ায়
দিগন্তব্যাপী সুনীল আকাশের নিচে আকাশমুখী দীর্ঘ ঘন ঝাউবন আর সবুজ তৃণভূমির বুকে জেগে থাকে এক সোনাঝরা বালুকাবেলা। সূর্যের আলোয় চকচক করা এই বালুকাবেলা যেন স্বর্গের সৌন্দর্যকে মর্ত্যে এনে দিয়েছে। ঝিনুক বাঁধানো সৈকতে লাল কাঁকড়ারা অবাধ বিচরণ, যেন তারা প্রকৃতির সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, একসময় বিদেশি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ কক্সবাজারের মহেশখালীর উপকূলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। মালবাহী এই জাহাজে ছিল প্রচুর পরিমাণ সোনা। নাবিকদের সঙ্গে জলদস্যুদের সংঘর্ষে পুরো জাহাজ সাগরে তলিয়ে যায়। পরবর্তী সময় দুর্ঘটনাস্থলে বালু ও পলি জমে আস্তে আস্তে একটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। এই সোনাবাহী জাহাজডুবির ঘটনার কারণে স্থানীয় জেলেদের মধ্যে দ্বীপটি পরিচিত হয়ে ওঠে স্বর্ণদ্বীপ বা ‘সোনাদিয়া দ্বীপ’ নামে।
আমাদের যাত্রা ছিল এই স্বর্ণদ্বীপের খোঁজে। দুই দিন এক রাতের সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অভিযান। যান্ত্রিকতা পেরিয়ে গ্রীষ্মকালীন লম্বা অবকাশে ইতিমধ্যে পরিকল্পনা করে রাখা পাহাড়-সাগর পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন যেন সত্যি হতে চলল। গত ৮ জুন তল্পিতল্পা গুছিয়ে কক্সবাজার এক্সপ্রেসে রওনা দিই বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতের উদ্দেশে। ঠিক ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা গিয়ে পৌঁছাই কক্সবাজারে। এদিন পুরোটা কেটেছে কক্সবাজারের প্রায় প্রতিটি সৈকতের বালুকাবেলায়। ঝোড়ো হাওয়া, মেঘলা আকাশ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে আমরা সুগন্ধা, লাবণী, হিমছড়ি, কাঁকড়া, ইনানী, পাটুয়ার টেক সৈকত কোনোটিই বাদ রাখিনি। সমুদ্রের পানিতে গা ভেজানো কিংবা সৈকতে দল বেঁধে ফুটবল খেলা, সবই ছিল দিনটির অংশ। সঙ্গে ‘মিনি বান্দরবান’খ্যাত পাহাড়চূড়া জয়ের অংশ বাদ যায়নি। পাহাড়ে চড়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখার অনুভূতিই অন্য রকম।
রাতটা কক্সবাজারের বন্ধুর বাসায় কাটিয়ে ভোর হতেই রওনা দিলাম কস্তূরী জেটিঘাট বা ৬ নম্বর জেটিঘাটে। সেখান থেকে স্পিডবোটে বাঁকখালী নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম মহেশখালী ঘাট। মহেশখালী ঘাট থেকে অটোরিকশায় চড়ে ঘটিরঘাট, আর সেখান থেকে উঠে বসলাম সোনাদিয়ার খেয়ায়। ইঞ্জিনচালিত খেয়াটি ছিল সেদিনের সর্বশেষ যাত্রীবাহী। সারা দিনে মাত্র দুই থেকে তিনটি খেয়া বা ইঞ্জিনচালিত বোট মহেশখালী থেকে সোনাদিয়া যাতায়াত করে। মহেশখালী খাল দিয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সোনাদিয়ার একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম নৌপথ।
আমরা যখন সোনাদিয়ায় পৌঁছলাম, তখন ভাটা চলছে। চোরাবালির মতো কাদায় তলিয়ে যায় পা। হাঁটুসমান কাদা পেরিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়ে উঠলাম সোনাদিয়ার পাড়ে। আহা সোনাদিয়া! সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো বিস্তীর্ণ মাঠ, নির্জনতা ও দমকা বাতাস প্রশান্তি ভরে দেয় মনে। নীল জলরাশি, সাদা বালুকাময় সৈকত আর ঝাউগাছের সারি। যেন কোনো অজানা রঙিন ছবির মধ্যে এসে পড়েছি।
দ্বীপের পশ্চিম তীরে প্রশস্ত বালিয়াড়ি আর লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। প্রকৃতির এই রূপের তুলনা হয় না। পূর্ব তীরে ম্যানগ্রোভ বন। সূর্যের আলো যখন শ্বাসমূলের ওপর পড়ে, তখন মনে হয় যেন প্রকৃতির অজস্র রত্ন ছড়িয়ে আছে। আর ঝোড়ো বাতাসে ঝাউবনে সুরেলা ঝিলমিল।
এ দ্বীপের মানুষেরা অতি সরল, হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তাঁদের প্রধান জীবিকা মাছ ধরা আর সামুদ্রিক শামুক সংগ্রহ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, শীতকালে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে এখানে। পাখির কলকাকলি আর তাদের ডানার ঝাপটানি দ্বীপটিকে জীবন্ত করে তোলে।
দ্বীপে পৌঁছেই দৌড়ে চলে যাই সমুদ্রে, দিগন্তব্যাপী বিশাল সৈকতে আমরা ছাড়া কেউ নেই। বিস্তীর্ণ বালুর মাঠে ফুটবল খেলা আর সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ যেন মুহূর্তেই শৈশবের খেয়ালিপনা মনে করিয়ে দেয়। আর দ্বীপের নির্জনতা নিয়ে আসে অসীম একাকিত্বের ছাপ। সন্ধ্যায় পশ্চিম তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা দুরূহ। সূর্য যখন ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলে ডুব দেয়, আকাশের রং বদলে যায়। নীলের সঙ্গে কমলা, লাল, গোলাপি আর বেগুনি রঙের মেলবন্ধন যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব আঁকা ছবি।
দ্বীপের নৈঃশব্দ্যময় রাত্রি যেন এক জাদুকরি অভিজ্ঞতা, যাকে কোনো তুলনায় ফেলা যায় না। দিনের আলো যখন পশ্চিমে মিলিয়ে যায়, সাগরের ঢেউয়ের গর্জন প্রকট হয়ে আসে, শুরু হয় রাতের কাহিনি। সূর্যাস্তের পরপরই যেন দ্বীপে নেমে আসে হাজার বছরের পুরোনো অন্ধকার। আকাশে ছড়ানো অসংখ্য তারা যেন স্বর্গ থেকে ছিটকে পড়া আলোকরেণু। আমরা ক্যাম্প স্থাপন করলাম সৈকতের ধারে প্রশস্ত ঝাউবাগানে, যাতে সমুদ্রের গর্জন আমাদের সঙ্গ দেয়। স্থানীয় লোকজন আমাদের রাতে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। কিছু বাড়িতে সোলার প্যানেল আছে, তা-ও বেশিক্ষণ আলো দেওয়ার মতো শক্তিসম্পন্ন নয়। আলো বলতে দূরের ঝুপড়ি ঘরের কুপি, মোমবাতির মিটিমিটি আলো আর বিশাল আকাশে তারার ঝিকিমিকি। পুরো দ্বীপে বাজার বলতে আছে নির্দিষ্ট দূরত্বে হাতে গোনা দু-তিনটি ঝুপড়ি দোকান। দ্বীপবাসীদের রাতের জীবন পর্যবেক্ষণে বের হয়ে বুঝতে পারলাম, আমরা যেন টাইম ট্রাভেল করে আশির দশকের কোনো গ্রামে এসে পৌঁছেছি। এক জায়গায় সোলার ল্যাম্পের আলোর নিচে লোকজনের উৎসুক জড়ো দেখে এগিয়ে গেলাম। দেখি, নরসুন্দর চুল কাটছেন, আর তাঁকে ঘিরেই একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। সপ্তাহে এক দিন এই দ্বীপে নরসুন্দর আসেন।
আমাদের রাতের খাবারের আয়োজনে ছিল চিকেন বারবিকিউ আর রুটি। দল বেঁধে মোমের মিটিমিটি আলোয় খাওয়ার দৃশ্য যেন আধিভৌতিক পটভূমি সৃষ্টি করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের তারা আরও উজ্জ্বল হয়। ক্যাম্প থেকে দূরে বেলাভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায়, দূরের জেলে নৌকার ছোট ছোট প্রদীপের আলো। সাগরের ঢেউয়ের গর্জন আর রাতের পাখিদের ডাক যেন এক অপার্থিব সংগীত। এর বাইরে যা আছে, তা হলো হাজার বছরের নিঃসঙ্গ নির্জনতা। সৈকতের বালুতে লাইন ধরে বসে আকাশের তারা গুনতে গুনতে মনে হলো, আমি যেন পৃথিবীর একেবারে প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।
তবে রাতটি ছিল ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে প্রচণ্ড বাতাস থাকলেও একটু ভেতরে এলেই সেই বাতাস উধাও হয়ে যায়। বিশাল ঝাউবন দেয়ালের মতো বাতাসে বাধার সৃষ্টি করে। আর্দ্রতা ৯৫ শতাংশের বেশি। অসহ্য গরম হয়ে ওঠে রাতের দ্বীপ। সমুদ্রের পানির ক্রমাগত বাষ্পীভবন দ্বীপের বায়ুমণ্ডলে প্রচুর জলীয় বাষ্প যোগ করে। ফলে দ্বীপের বাতাসে আর্দ্রতা থাকে বেশি। আর্দ্র বাতাস তাপমাত্রা কমানোর পরিবর্তে গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে যোগ হয় মশার কামড়। লাখ লাখ মশা চারদিক থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে যেন আক্রমণ করে। দ্বীপে প্রচুর স্থির জলাশয় ও জলাভূমি আর উচ্চ আর্দ্রতা মশার বংশবিস্তারের যেন মোক্ষম পরিবেশ।
সারা দিনের ধকল শেষে অসহ্য গরম আর মশার কামড়ে সে রাতে আর কারও ঘুম হয়নি। সৈকতের বালুতে হেঁটে, শুয়ে রাতের আবছা আলোয় বিশাল সফেদ ঢেউ, দূরে জেলে নৌকা আর জাহাজের আলো দেখে, সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে কেটে যায় সোনাদিয়ার সেই ভয়ংকর রাত। যদিও শেষ রাতে ঘুমে চোখ নেমে আসে। ভোরের প্রথম আলো ফুটতে না ফুটতেই সেই ঘুম ভাঙে। সোনাদিয়া দ্বীপের প্রভাত যেন এক নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয়। রাতের অন্ধকারে মিশে থাকা সব রহস্য ফিকে হয়ে আসে, যখন প্রথম প্রহরের আলো ধীরে ধীরে পুব আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন সাগরের নীল জলরাশি স্বর্ণালি আভায় ঝলমল করে ওঠে। প্রশান্তির মৃদু বাতাসে যেন প্রকৃতি তার শীতল আঁচল বিছিয়ে পৃথিবীকে জাগিয়ে তুলছে। সূর্যের প্রথম কিরণ সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর পড়ে সোনার মতো ঝিকমিক করে।
প্রাতরাশ সেরে দল বেঁধে বের হই পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। ক্যাম্পিং পয়েন্ট থেকে হাঁটতে শুরু করি সোজা উত্তরের শেষ মাথা পর্যন্ত। বেলাভূমির ওপর ছোট ছোট লাল কাঁকড়ার ঝাঁক, আমাদের দেখলেই গর্তে লুকায়। ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শামুক ও ঝিনুক সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে। শুরু হয় স্থানীয় লোকজনের কর্মব্যস্ততা, জেলেরা নৌকা ও জাল নিয়ে সাগরে রওনা দেন। সৈকতের ধারে ম্যানগ্রোভের গাছপালা সূর্যের আলোয় এক নতুন রূপ ধারণ করে। বেলা বাড়তে বাড়তে বাড়ে সূর্যের তাপের প্রখরতা, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বালু। উত্তপ্ত বালুতে ক্লান্তি-তৃষ্ণায় ক্যাম্পে ফিরে আসতে সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছিল। ক্যাম্পে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম ফেরার পথে। হয়তো আর কখনো যাওয়া হবে না, তবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, মানুষের আন্তরিকতা এবং নির্ঘুম ভয়ংকর রাত—সবকিছু মিলিয়ে সোনাদিয়া জীবনের এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। ফিরে এসে আবারও গতানুগতিক যান্ত্রিক কোলাহলে দাঁড়িয়ে সোনাদিয়ার নির্জনতা আর সৌন্দর্য যেন আরও বেশি করে অনুভব করতে পারলাম।
লেখক: অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ, শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়