উৎমাছড়ায় যখন সন্ধ্যা নামে
মাসখানেক আগে। শরতের আকাশের নিচে রাস্তার দুপাশের জলাভূমিতে সবুজ ফসল উঁকি দিয়ে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা ছুটে চলছি পাহাড়ের পাদদেশে এক ছড়ার জলে পা ভেজাতে। এর আগে সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে চা-বাগানের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। দুপাশে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা সাদা কাশফুলের দল আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে আপন তৃষ্ণায়। শরতের এই সময়েও বাগানে নারী শ্রমিকদের চা-পাতা তোলার দৃশ্যে চোখ আটকে যায় আমাদের। চা-বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে লোকালয় থেকে যত পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, মেঘে আচ্ছন্ন সেই পাহাড় আমাদের তত কাছে ডাকছিল। সিলেট থেকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছে ৪৫ মিনিট। কোম্পানীগঞ্জ বাজার থেকে ডানে মোড় নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম গ্রামের সরু ও ভঙ্গুর সড়ক ধরে। সড়কের দুপাশে পাথরকোয়ারিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল এ অঞ্চলের ভূগর্ভে থাকা খনিজ সম্পদের কথা। বিকেলের হলুদ আলোয় পাহাড়ের ওপর মেঘের অবস্থান আরও পরিষ্কার করেছে আমাদের কাছে। দূর থেকে দেখলে চোখে ভাসে পাহাড়ের বুকে গাঢ় সবুজের আস্তরণ।
দেড় ঘণ্টার যাত্রা শেষে বিকেল পাঁচটায় আমরা অবশেষে পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ‘উৎমাছড়ায়’। দূর থেকে পাহাড়ের ওপর স্বচ্ছ জলরাশির যে ঝরনাটা দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা, তার থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহিত হয়ে থাকে এই ছড়া দিয়ে। স্থানীয় লোকজন এই ছড়াকে নিজেদের আশীর্বাদ হিসেবে ব্যবহার করে। অনেকের আবার এই ছড়াতেই জীবন পার হয়ে যায়। ছড়ায় নেমে হাঁটা শুরু হয় দেশের সীমানার শেষ বিন্দুর দিকে। ছড়াভর্তি ছোট-বড় পাথরের মাঝ দিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে চলেছে শীতল স্বচ্ছ জলরাশি। পাথর ছড়ানো সর্বত্র। আকাশে নীলের ছায়া। ছড়ার পানিতে নিজেদের মুখমণ্ডলের ছবি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমরা। এখানে বসে জয় গোস্বামীর কবিতা মনে পড়ে আমাদের। হয়তো তিনি এমন ছড়ায় বসেই লিখেছিলেন, ‘হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।’ দেশের সীমারেখার শেষ বিন্দুতে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। আর এই ঘরকে নিজেদের বিশ্রামের আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা।
এখানে এটিই হয়তো দেশের সর্বশেষের ঘর। পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ জলরাশি আর পাথরের মাঝে এ কুঁড়েঘরে সীমান্তের যে প্রহরী রাত কাটান, দেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার একটিতে থাকার সৌভাগ্য তাঁর। বিকেলের আলো নিভে যখন সূর্য পশ্চিমের আকাশে অনেকটা ডুবে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আমরা ফিরতে শুরু করি। সারা দিনের সব দুঃখবোধের গ্লানি মুছে ফিরতে থাকি ঘরের পথে। উৎমাছড়া জায়গাটি পর্যটকদের মন সেভাবে কেড়ে নিলেও যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় তাঁরা সেখানে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন না। তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে প্রকৃতির দান হিসেবে রূপ-লাবণ্যে যৌবনা উৎমাছড়া নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে সম্মোহনী সৌন্দর্য। যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্ত নির্জন অরণ্যের সাহচর্য পেতে উৎমাছড়ার বিকল্প নেই। যেখানে দিগন্তবিস্তৃত সবুজের সমারোহ কাছে ডাকে আপন হয়ে, আকাশে বিস্তৃত সাদা মেঘের খেলা, পাথর ছড়ানো চারপাশ, দুধসাদা জলরাশি, পাখিদের কলতানমুখর এমন জায়গায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই! প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে উৎমাছড়া। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নে উৎমাছড়ার অবস্থান।
সিলেট শহর থেকে যেভাবে যাবেন এই ছড়ায়
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেটে এলে সিলেট শহরের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সরাসরি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়া যায় দয়ারবাজারে। রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় ৩৫ কিলোমিটারের এই জায়গার ভাড়া জনপ্রতি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। দয়ারবাজার থেকে আবার অটোরিকশাযোগে আপনাকে যেতে হবে চড়ারবাজারে। এই ৮ কিলোমিটার রাস্তা যাওয়ার জন্য জনপ্রতি ভাড়া গুনতে হবে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। চড়ারবাজার থেকে হেঁটে উৎমাছড়া মূল স্পটে যেতে সময় লাগবে ১০ থেকে ১৫ মিনিট।
লেখক: দেলোয়ার হোসেন, শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়