এ যেন সুন্দরবনেরই প্রতিচ্ছবি
প্রকৃতিঘেরা অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ডোমখালি উপকূলীয় বনাঞ্চল ও সমুদ্রসৈকত। মিরসরাই উপজেলার সর্বদক্ষিণ-পশ্চিমে ১৬ নং সাহেরখালি ইউনিয়নে এর অবস্থান।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়দারগারহাট বাজারে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যেতে হয় ডোমখালি বেড়িবাঁধে। মোটরসাইকেল বা কার নিয়েও যাওয়া যায় সেখানে।
বড়দারগারহাট বাজার থেকে বায়ান্ন বাঁকের গ্রামবাংলার মেঠো পথ ধরে বেড়িবাঁধের ওপরে গিয়ে গাড়ি থামে। পথিমধ্যে বেড়িবাঁধের একটু আগে চোখে পড়বে জেলেপল্লি। সাগরকে কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এ পল্লি।
আপনি চাইলে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে দেখতে পারেন জেলেদের জীবনবৈচিত্র্য। বেড়িবাঁধে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামামাত্রই কান পাতলে শুনতে পাবেন বিশাল সমুদ্রের গর্জন। দখিনা মিষ্টি ও নির্মল বাতাস আপনার শরীর–মনকে করবে শীতল। সড়কের ওপরে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন, দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ। আর সোনালি ফসলের মাঠে আপন মনে কাজ করছেন কৃষকেরা। শেষ বিকেলে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষের পাল নিয়ে বাড়িতে ফিরছেন রাখাল। বেড়িবাঁধের দুই ধারে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ জনপদ এবং সারি সারি লাগানো আছে খেজুর, নারকেল, তাল, ঝাউ, সেগুন, ইপিলইপিল, আকাশমণি, নিম, বাবলাসহ অসংখ্য গাছ।
আপনি যদি শীতের মৌসুমে যান, তাহলে খেজুরের মিষ্টি রসের স্বাদ নিতে পারবেন। সড়কের দক্ষিণে কেওড়া, বাইন, গড়ান, গেওয়া, সুন্দরী, হারগোজসহ লবণসহিষ্ণু নানা বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম; যা স্থানটিকে সবুজের সমারোহে পরিণত করেছে। যেদিকে তাকাবেন, শুধু সবুজ আর সবুজ। বাঁধের উত্তর ও পশ্চিমে বয়ে গেছে দৃষ্টিনন্দন সমুদ্রসৈকত। সাগরের কোলজুড়ে গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ বন। এই বনভূমিতে রয়েছে জীববৈচিত্র্যের সমাহার। এ বনে দেখা মিলবে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, পাখি (শকুন, কোকিল, চিল, ডাহুক), সাপ (অজগর), লজ্জাবতী বানর, মেছো বাঘ, কুমির, হরিণ, শিয়ালসহ বিরল ও মহাবিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের বিচরণ ও প্রজনন। খুব ভোরে ও সন্ধ্যায় ঘাস, লতাপাতা খাওয়ার জন্য বনভূমির বাইরে চরাঞ্চলে চলে আসে হরিণের দল। এ ছাড়া দিনের বেলায়ও বনের ভেতরে প্রবেশ করলে হরিণের পদচিহ্ন ও আনাগোনা লক্ষ করা যায়। বনের মধ্যে খাবারের খোঁজে মহিষের দল চরে বেড়ায়। এ অঞ্চলের অনেক মানুষ বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাওয়ালিদের কাঠ কাটার শব্দ আর পশুর গলায় ঝুলে থাকা কাষ্ঠঘণ্টার শব্দে মুখর থাকে বন।
বনের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় দেখতে পাওয়া যায়, কিছু দূর পরপর সাগরের সঙ্গে মিশে যাওয়া ছোট ছোট খালের অবিরাম বয়ে চলা। এই খালগুলো দিয়ে ভরা মৌসুমে জোয়ারের পানি বাঁধের কিনারে চলে আসে। বনের মধ্যে আরও শুনতে পাবেন পাখিদের কলকাকলি। বন শেষ হলে শুরু হয় কাদামাটি। সাগরের খুব কাছে জোয়ারের সময় ডুবে থাকা জায়গাগুলোতে ভাটার সময় ভেজা মাটির ছোট ছোট গর্তে লাল কাঁকড়া, সাগরের বিভিন্ন জাতের কাঁকড়া ও সামুদ্রিক নানা জাতের মাছ মাথা তুলে বসে থাকে এবং ছোটাছুটি করে। মানুষের আনাগোনা পাওয়ামাত্রই গর্তে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া সমুদ্রতীরে স্থানীয় বাসিন্দারা চিংড়িঘের করে চিংড়ির চাষ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের কারণে চার কিলোমিটারের মতো সৈকতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই ভ্রমণপিপাসুরা খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারেন সাগরের দৃষ্টিনন্দন, নৈসর্গিক, মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সাগরের ঢেউ যেন তাঁদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই প্রতিদিন বিকেলে সাগরপাড়ের সৌন্দর্য দেখতে যুবক-যুবতীদের ঢল নামে।
কবির মতে, ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা। সকাল বেলার আমির রে ভাই, ফকির সন্ধা বেলা রে ভাই।’
বিকেলের সময়টাতে নানা বয়সের মানুষের আগমনে ভিড় জমে সাগরপাড়ে। সমুদ্রের পানির ছুঁয়ে ভ্রমণপিপাসুরা দূর করেন মনের ক্লান্তি। ঘাটে বাঁধা থাকে বাহারি রংয়ের ডিঙি। জেলেরা মাছ ধরার জাল তুলতে সাগরে ছুটে চলেন। কেউ আবার সমুদ্রের নানা প্রজাতির তাজা মাছ নিয়ে ঘাটে নৌকা ভেড়ান। এ মাছ বিক্রি করে তাঁদের সংসার চলে। যাঁরা নৌকাভ্রমণ পছন্দ করেন, তাঁদের অনেকে জেলেদের নৌকা নিয়ে পাড়ি দেন সাগর মোহনায়। জেলেপল্লির পরিবারের বড়দের সঙ্গে ছোটরাও মাছ ধরতে সাগরে যায়। দুষ্টু ছেলেরা সাগরের পানিতে লাফালাফি করে। বিকেলে সমুদ্রের পাড় থেকে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অবলোকনের মাধ্যমে সমুদ্রের সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেঠান ভ্রমণপিপাসুরা।
যদিও অনেক ভ্রামণিক চান রাত্রীযাপন করতে। কিন্তু ভালো খাবারের হোটেল এবং আবাসিক হোটেল না থাকায় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হলে পর্যটনশিল্পের সহযোগিতায় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাবে এই এলাকা।
লেখক: ফরহাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, কার্যকরী সদস্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়