ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা ভ্রমণ, যে অভিজ্ঞতা হলো

৪ থেকে ৭ ডিসেম্বর ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ভারতের অন্যতম দর্শনীয় একটি স্থান আগরতলা থেকে ঘুরে এলাম। ভারতের এ রাজ্য দর্শন করলাম এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছিল গণমাধ্যমে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আগরতলা রাজ্যের কোনো হোটেলে বাংলাদেশি কাউকে জায়গা না দেওয়া। মনের জেদে তবু যখন এসেছি, যে করেই হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। থাকার জন্য প্রথমে মদনমোহন গেস্টহাউসে যাই। সেখানে না পেয়ে এরপর হজ¦ভবনে গিয়ে নামাজ আদায় করি। এখানেও থাকার জায়গা না পেয়ে চলে গেলাম আবুল কালাম আজাদ হোটেলে। সে স্থানে দুপুরের খাবার খেয়ে হতাশা নিয়ে পরিচিত এক দাদার সহযোগিতায় তাঁর বাড়িতে উঠি প্রতি রাত দুই হাজার রুপি দেওয়ার চুক্তি করে। এসে যখন পড়েছি, কী আর করা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেকে গেলাম।

সন্ধ্যায় দাদার সঙ্গে চলে গেলাম শীতের জ্যাকেট কেনার জন্য ফৌজিদের একটি শোরুমে। সেখান থেকে একটি জ্যাকেট ও এক সেট জগিং পোশাক কিনে চলে গেলাম বাগানবাড়িতে। নতুন স্থান, নতুন অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার। সন্ধ্যায় চলল আড্ডা, গল্প দুদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। প্রথম দিন এভাবেই শেষ হলো। দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই ভোরে দাদার বড় দাদাকে নিয়ে সিমান্তের পাশ দিয়ে জগিং করতে বের হলাম। চারদিকে কুয়াশায় ঘেরা পরিবেশ, এর মাঝেই সচেতন নাগরিক বের হয়েছে ব্যায়াম করার জন্য।

আগরতলা রাজ্যের একটি বিষয় খুব ভালো লেগেছে। তা হলো, তারা সবাই প্রায় স্বাস্থ্যসচেতন। পথিমধ্যে আগরতলার বিভিন্ন গলিতে বিভিন্ন স্থাপনা, পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দর্শনীয় বিভিন্ন স্থান, মসজিদ, মন্দির, মাঠ দেখে বাগানবাড়িতে ফিরলাম সকাল নয়টায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে বের হলাম শহরের দর্শনীয় স্থাপনা দেখার জন্য।

দ্বিতীয় দিনের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক গেদু মিয়ার মসজিদ। এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হচ্ছে—আবদুল বারিক খান (ডাকনাম গেদু মিয়া) ছিলেন সনামধন্য একজন ঠিকাদার। ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম ত্রিপুরায় বিমানবন্দর নির্মাণকাজের দায়িত্ব দেন তাঁকে। তখন রাজা গেদু মিয়াকে সাত লাখ টাকা দেন। এ টাকায় কিছু অংশ লাভ হওয়ায় লাভের টাকা দিয়ে গেদু মিয়া এ ঐতিহাসিক স্থাপনা নিমার্ণ করেন শহরের শিবনগরে। সে সময়ের ৬০ হাজার টাকা দিয়ে মসজিদটি নিমার্ণ করতে সময় লেগেছিল ৩ বছর। কারুকার্যময় এ ধর্মীয় স্থান দেখতে প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও পাশের বাংলাদেশ থেকে অনেক মুসলমান আসেন। মসজিদের পাশেই গেদু মিয়া ও তাঁর সহর্ধমিণীর সমাধিস্থল রয়েছে।

মসজিদ দেখা শেষ করে চলে গেলাম অন্য একটি স্থাপনায়—ঐতিহাসিক উজ্জয়ন্ত প্যালেস। ১৮৫৭ সালে ঝড়ে ভেঙে যায় রাজবাড়ি, রাজা তখন নতুন করে ১ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে নতুন করে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে মোঘল ও রোমান ভ্যাটিকান প্রাসাদের আদলে তৈরি করেন বর্তমান রাজবাড়িটি। এ প্রাসাদের চারপাশে ৩টি দিঘি রয়েছে—কৃষ্ণসাগর, দুর্গাবাড়ি দিঘি ও রাধাসাগর দিঘি, যা প্রাসাদের সৌন্দর্যকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগরতলার সবচেয়ে জনপ্রিয় এ উজ্জয়ন্ত প্রাসাদটি স্থানীয়ভাবে রাজবাড়ি নামে অধিক পরিচিত।

রাজার সে সময়ের রাজপণ্ডিত চন্দ্ররায় বিদ্যাবিনোদ প্রাসাদের নাম রাখেন উজ্জয়ন্ত। ২০১২ সালে এখানে জাদুঘর স্থাপন করা হয় এবং তখন থেকে এটি স্টেট মিউজিয়াম হিসেবে পরিচিত লাভ করে। প্রাসাদের প্রবেশপথেই ভারতের বিশাল একটি পতাকা রয়েছে। দুপাশে শহীদ ক্ষুদিরাম বসু, এক পাশে চট্রগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মহানায়ক মাস্টারদা সুর্য সেন ও মাঝখানে রয়েছে আগরতলা রাজ্যের সাবেক মহারাজা বীরবিক্রমের ভাস্কর্য। প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বাগান, যা এ ঐতিহাসিক স্থাপনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করেছে। রাজবাড়ি প্রবেশ সময় বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এখানে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, যা আগত পর্যটকদের বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা বা তথ্য দেয়। উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ দেখার পর পর্যায়ক্রমে আমি ত্রিপুরা রাজ্যের অন্য দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করলাম।

তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে বিবেক উদ্যান, হেরিটেজ পার্ক, নেহরু পার্ক, বাণিজ্য মেলা, শিশু উদ্যান, আগরতলা পুলিশ হেডকোয়ার্টার, ঐতিহাসিক জগন্নাথ মন্দির ও জগন্নাথবাড়ি পার্ক, ঊমাকান্ত একাডেমি, সায়েন্স সিটি, বটতলা বাজার। প্রতিটি স্থানের বিশদ বিবরণ বিস্তারিত তুলে ধরলে এ ভ্রমণকাহিনী দীর্ঘ হবে, এ জন্য মূল তিন–চারটি স্থানের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছি।

তৃতীয় দিনে সকাল ৯টায় রওনা দিলাম আগরতলার অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান নীরমহল, যা রুদ্রসাগরের মাঝখানে অবস্থিত। এখানে আসলে রাজকীয় একটি গেট আপনাকে স্বাগত জানাবে।

নীরমহল প্রাসাদ। সমগ্র ভারতবর্ষে এমন মনোরম প্রাসাদ রয়েছে মাত্র দুটি, যা দেখতে প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও দেশের বাইরে থেকে হাজারো দর্শনার্থী আসেন। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়াটার প্যালেস। রাজা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন অবকাশযাপনের জন্য সুন্দর–মনোমুগ্ধকর এ প্রাসাদ নিমার্ণ করেন রুদ্রসাগরের মাঝখানে। সাদা ও লাল রঙের সৌন্দর্য যে কত সুন্দর হতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছে ঐতিহাসিক এ জলপ্রাসাদ।

আগরতলা থেকে এ স্থানের দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার, যা মেলাঘর নামের স্থানে অবস্থিত। মাত্র ৫০ রুপি বিনিময়ে বোটে উঠে অপর পাশে গিয়ে ৩০ রুপিতে প্রাসাদে ঢুকতে পারবেন। ১৯৩০ সালে নিমার্ণ শুরু করে ১৯৩৮ সালে শেষ হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর এ প্যালেশ নিমার্ণ করেন। প্রাসাদে যাওয়ার পথে শীতল এক অনুভুতি আপনার মনকে শীতল করে দেবে মুহূর্তেই। এ ছাড়া ৪০ মিনিট সময় পাবেন এ স্থান পরিদর্শন করার জন্য। প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার ছাদে পাবেন প্রাণবন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাণজুড়ানো শীতল বাতাস, যা সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেবে নিমেষেই।

নীরমহল দেখে আগরতলা যাওয়ার পথে মাঝে দেখতে পেলাম সিপাহিজলা চিড়িয়াখানা, পাহাড়ি রাস্তা, চা-বাগান ও আগরতলা বিশ্ববিদ্যালয়। আগরতলা পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ঢুকে পড়লাম বাজার কলকাতায়, কিছু সময় থাকার পর নেমে রূপসী সিনেমা হলে ‘পুষ্পা ২’ দেখার জন্য টিকিট কেটে সিনেমা দেখলাম। সিনেমা শেষে আগরতলা রাজবাড়ির পাশে স্টিট ফুডের স্বাদ নিলাম। এভাবে রাত নয়টা বেজে গেল। চলে এলাম বাগানবাড়িতে, এসে রাতের খাবার খেতেই ক্লান্ত শরীর ঘুমের জানান দিচ্ছে। পরদিন শনিবার ভোরে উঠে জগিং করতে করতে চলে গেলাম আগরতলার সবচেয়ে পরিচিত স্থান বটতলা বাজারে সকালের নাশতা ও চা খেতে। বটতলা মাছবাজার ঘুরে, শহরের চারপাশের দৃশ্য দেখে চলে এলাম। এভাবেই নানা রকম ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন ও স্মৃতি নিয়ে শেষ করলাম চার দিনের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা ভ্রমণ।

  • লেখক: ফিরোজ হোসেন ফাইন, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট

  • নাগরিকে লেখা, ভিডিও, ছবি, ভ্রমণকাহিনি পাঠান [email protected]