পাহাড়ের পাদদেশে সাদা পাথরের জাদু

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেছবি: লেখকের সৌজন্য

সিলেটের কথা মনে হলে চোখে চা–বাগানের কথা ভেসে ওঠে। সিলেট থেকে আগত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বন্ধুদের মুখেও সেই গল্প শুনেছিলাম। তাই সুযোগ খুঁজতে থাকি সাদা পাথর আর চায়ের দেশে যাওয়ার। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সে সুযোগ এনে দিল।

প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর অফিসের স্টাফদের নিয়ে ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। এবার সিলেট যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। ভ্রমণের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিলেন লেখক ও গবেষক জুলফিকার আলী ভাই। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন পুরো শীত মৌসুম। একে তো কনকনে ঠান্ডা, তার ওপর রাতের ভ্রমণ। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হলো। শীতে দূরের ভ্রমণে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেই টিপস দিয়ে আমার কাজ সহজ করেছিলেন জাকির ভাই। রাত ১১টার দিকে আমাদের বাস রওনা হলো সোসাইটি প্রাঙ্গণ থেকে।

পৌষের সকালে চা–বাগানে

শীতে রাস্তায় কুয়াশা পড়ে, তাই এ সময়ে রাতে ভ্রমণ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলা চলে। সে কারণে হয়তো আমাদের অনেকেই বাসে ঘুম এড়িয়ে গেলেন। আমরা ভোর ছয়টার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। উঠলাম সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে। এটি টিলার ওপর অবস্থিত। আমরা বিশ্রাম নেওয়ার তেমন সময় পেলাম না। কেননা, সকালে দ্রুত নাশতা করে বেরিয়ে পড়তে হবে। এদিকে বন্ধু ফেরদৌস ও তৈবুর তাড়াতাড়ি করছিল। ইমন আমাদের রুমেই ছিল। ও বারবার প্রস্তুতির কৌশল ভাগাভাগি করছিল। গেস্ট হাউস থেকে বের হয়ে সুব্রত দাদার সাথে দেখা। তিনি হারুন ভাইকে ভিডিও কলে চারপাশ দেখাচ্ছিলেন। সুব্রত দাদা বেশ গোছালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন বলে আমার কাছে মনে হলো। একটু এগিয়ে যেতেই চারপাশের প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ল। এমনকি হাঁটার সময় আমরা কয়েকটি রেসাস বানরের লাফ–ঝাঁপ উপভোগ করলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন রাশেদ ভাই। তিনি বানরের উক্ত প্রজাতি নিয়ে আমার কাছে আলোচনা করলেন। চারদিকে পাখির কলতান কানে ভেসে আসছিল। আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল হলো চা–বাগান। বাস কিছুদূর যেতেই সারি সারি চা বাগান চোখে পড়ল। মুকবিল ভাই মালনীছড়া চা–বাগানে নামার জন্য পরামর্শ বলছিলেন। কিন্তু যেতে হলো অন্য চা–বাগানে। নেমে দেখলাম, যেদিকে চোখ যায় শুধু বাগান আর বাগান। আমি বাগানে নেমেই পাতা ছুঁয়ে দেখছিলাম।

সাদা পাথরের রাজ্যে

পৌষের সকালে চা–বাগানের পাতাগুলোকে মনমরা লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কখন বসন্ত আসবে সে অপেক্ষায় আছে তারা! আমাদের ভ্রমণের অন্যতম মূল আকর্ষণ ছিল সাদা পাথর।এবার আমাদের বাস ভোলাগঞ্জের দিকে চলতে শুরু করল। সাদা পাথরের এলাকার যতই কাছাকাছি হচ্ছিলাম, ততই মেঘালয়ের উঁচু পাহাড় দৃশ্যমান হচ্ছিল। কী অপূর্ব দৃশ্য! বাস থেকে নেমে ব্যাপক পর্যটকের উপস্থিতি দেখলাম। ইতিমধ্যে আমাদের দলটির একটি অংশ নদী পার হলো। তাই আমাদের যেতে হলো পরের ধাপে। জুলফিকার ভাই হিসাব টুকে নিচ্ছিলেন এবং সবাইকে চমৎকারভাবে গাইড করছিলেন। আমরা দুপুরের খাবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। বাস থেকে নেমে আমি বেশ মজা করে খেলাম। বন্ধু ফয়সাল আমাকে পানিতে গোসল করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে সাহায্য করল। খাওয়া শেষ করে আমাদের দলটি এগোতে থাকল। এরপর নৌকায় করে ধলাই নদ পার হতে থাকলাম। সামনে থাকা পাহাড়টি আরও দৃশ্যমান হচ্ছিল এবং আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। পাহাড়ের এত ওপরে বিভিন্ন রঙের ঘরবাড়ি দেখে অবাক হলাম। কিছুদূর হাঁটার পর সারি সারি দোকান চোখে পড়ল। সাদা পাথর এলাকায় পৌঁছে চোখ আমার ছানাবড়া! সেখানে লোকজন গিজগিজ করছিল। অনেক মানুষ পানিতে হাঁটছিল এবং তারা পানির প্রবাহ ছুঁয়ে দেখছিল। যেতে যেতে শূন্যরেখায় পৌঁছে আমরা বিজিবির একটি ক্যাম্প আবিষ্কার করলাম। এর পাশেই ছিল মসজিদ। ক্যাম্প–সংলগ্ন স্থানটিতে পানির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি ছিল, তাই আমাদের কেউ কেউ সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল! পানিতে থাকা সাদা পাথর বেশ পিচ্ছিল ছিল। তাই বন্ধু ফেরদৌস আমাকে হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে বলছিল। কড়া রোদ আর চারপাশে পাহাড় ঘিরে যেন সাদা পাথরের এক স্বর্গরাজ্য! আমার হলের ছোট ভাই লিমন পানিতে নেমে বেশ খুশি।আমাকে ছবি তোলায় সে উদ্বুদ্ধ করল।আমরা সবাই পানিতে গোসল সেরে নিলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। কমছিল রোদের তেজও। এবার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসের দিকে ফেরার পালা।

সিলেটের চা–বাগানে
ছবি: লেখকের সৌজন্য

প্রসিদ্ধ দুই মাজার ও সাত রঙের চা

আমাদের দলের প্রথম অংশটি ইতিমধ্যে বাসে পৌঁছে গেছে। কেউ কেউ দুপুরের খাবার খেতে শুরু করল। এর কিছুক্ষণ পর বাস চলতে শুরু করে। জাহাঙ্গীর ভাই মুকবিল ভাইকে নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠলেন। আমিও তাতে যোগ দিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল। এ সময় কিছুটা শীত অনুভূত হচ্ছিল। গেস্ট হাউসে পৌঁছে রাতের ঘোরাঘুরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। জনি ভাই রুমে রুমে সবার খোঁজখবর নিলেন। যাহোক সিদ্ধান্ত হলো সবাই যার যার মতো রাতের সিলেট শহর উপভোগ করবে। ৩৬০ আউলিয়ার দেশে এসে শাহ পরান (রহ.) ও শাহ জালাল (রহ.) এর মাজার দেখেনি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেটি মাথায় রেখে আমি ফেরদৌস আর তৈবুর মাগরিবের পরপর বের হয়ে পড়ি। বন্ধু ফেরদৌস বেশ গোছালো মানুষ। এবারও আমাকে অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। গেস্ট হাউসের গেটে জুলফিকার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। সবাই ভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। আমরা প্রথমে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাত রঙের চা খাওয়ার জন্য রওনা দিই। শাহ পরান (রহ.)–এর মাজারের কাছেই সাত রঙের চায়ের দোকান। সেখানে চা খেয়ে মাজারে চলে যাই। এখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করি। তারপর ঝটপট শাহজালাল (রহ.)–এর মাজারের দিকে রওনা দিই। এই মাজারে লোকজনের ব্যাপক উপস্থিতি খেয়াল করলাম। মাজারসংলগ্ন পুকুর দেখার পর চারপাশ ঘুরলাম। ভবনগুলোতে অনেক কবুতরের আনাগোনা নজরে পড়ল। মাজার থেকে বের হয়ে দোকানপাটে হরেক রকম মজাদার খাবার দেখলাম। আমরা হালুয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। জুলফিকার ভাই আমাদের হালুয়া কিনে খাওয়ালেন। খেয়ে বেশ মজা পেলাম। এবার সিএনজিতে করে গেস্ট হাউসের দিকে ছুটলাম। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে ঢাকার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। বাসে শামীম ভাই আমার ঠিক পিছনের সিটে বসে ছিলেন। ভাইকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখলাম। সারা দিন ছোটাছুটি করে সবার শরীরেই ক্লান্তির ভাব দেখা গেল। আমি লম্বা ঘুম দিলাম। বাস সকাল হওয়ার আগেই ঢাকায় পৌঁছে গেল।

প্রয়োজনীয় পরামর্শ

সিলেটের যাতায়াতব্যবস্থা খুবই ভালো। ঢাকার সায়েদাবাদ ও আরামবাগ থেকে বাস পাওয়া যায়। ট্রেনেও যাতায়াতের সুবিধা রয়েছে। সিলেটে গেলে যানজট এড়াতে নৈশভ্রমণ করতে পারেন। রাস্তার কোথাও কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ, তাই চালকের দিকে খেয়াল রাখবেন। একাধিক দর্শনীয় স্থান ভালো করে উপভোগ করতে চাইলে কমপক্ষে দুই দিন সময় হাতে নিয়ে যাবেন। শীত মৌসুমের চেয়ে গ্রীষ্মে সাদা পাথর, জাফলং ও রাতারগুল বেশি উপভোগ্য। এসব স্থানে গোসল করলে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় সঙ্গে নিয়ে যাবেন। কেননা, সেখানে এসবের দাম খুবই চড়া। পাথর বেশ পিচ্ছিল, তাই খালি পায়ে হাঁটবেন। চাইলে ছোট সাইজের সাদা পাথর পরিবারের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেন। মাজারগুলোতে রয়েছে প্রতারকদের আনাগোনা। তাই সতর্ক থাকতে হবে।আবার একটু সাবধান না হলে কেনাকাটা কিংবা ভাড়ায় প্রতারণার শিকার হতে পারেন। সিলেটে চা–পাতার মান খুব ভালো এবং দামেও সস্তা। চা–পাতা ভালো দোকান থেকে সংগ্রহ করবেন। গুগল ম্যাপে দর্শনীয় স্থানগুলোর অবস্থান ভালো করে বিশ্লেষণ করে গেলে সময় বাঁচবে আপনার।

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়