বরফের রাজ্যে চার বন্ধুর রোমাঞ্চ

সারা রাত ভ্রমণ শেষে খুব ভোরে পৌঁছালাম বুড়িমারী স্থলবন্দরে। ফ্রেশ হয়ে নিলাম সবাই। বুড়িমারীর খাবার দোকানে নাশতা সেরে নিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে ইমিগ্রেশন শেষ হলো। ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। রওনা দেওয়ার আগেই চ্যাংড়াবান্ধা থেকে ডলার এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছিলাম। কারণ, এখানে শিলিগুড়ি বা গ্যাংটকের চেয়ে ভালো রেট মেলে।

ঘুরতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। তাই সুযোগ পেলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটে যাই। এবারের ঘটনাটা একটু আলাদাই বটে। আমাদের টিমের চারজনই প্রথমবার সিকিম ভ্রমণে যাচ্ছে। তাই জার্নিটা একটু রোমাঞ্চকর হবে, সেটা পূর্বেই অনুমেয় ছিল।
শীতকালে পাহাড় ভ্রমণের মজাই আলাদা। তাই তো শীতের মজা পেতে আমাদের এত আয়োজন। টিম লিডার রাসেলের নেতৃত্বে আমাদের ছুটে চলা। সীমান্তের পৌঁছাতেই বিপত্তি বাঁধলো। অমিত আর প্রীতম ভুলে ট্রাভেল ট্যাক্সের কাগজ ফেলে এসেছে। আমার মাথায় হাত পড়ে গেল। তবে রাসেলের মুখে হাঁসি ছিল। বলল, সমস্যা নেই, বর্ডারে ব্যাংক আছে, নতুন করে ট্রাভেল ট্যাক্স দেওয়া যাবে।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল খুব সকালেই বর্ডার পাস করা। তারপর শিলিগুড়ি গিয়ে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। এরপর গন্তব্যে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাভেল এজেন্সি ঠিক করা। কিন্তু দেরি হওয়ায় আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কারণ, রাত আটটার মধ্যে গ্যাংটক থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে হয়। তাই নিরুপায় হয়ে শিলিগুড়ি থেকেই ট্রাভেল এজেন্সি ঠিক করতে হয়। এতে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য যাবতীয় অনুমতির কাজ তারাই করে দেয়। এতে করে আমাদের আর কোনো বিপত্তি বাঁধলো না।

দুপুর আড়াইটার দিকে পৌঁছালাম শিলিগুড়ি। তারপর লাঞ্চ সেরে নিলাম। দার্জিলিং ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে একটি ছোট টাটা অল্টো গাড়িতে রওনা হলাম সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। সুবিশাল পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হিমশীতল ঝিরিঝিরি হাওয়ার অনুভূতি নেওয়ার এক অভূত স্থান হলো সিকিম।

ছোট্ট শিলিগুড়ি শহর, ক্যান্টনমেন্ট, সেভক এরিয়া পাড়ি দিয়ে গাড়ি চলছে তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষা সড়ক ধরে। তিস্তার নীলচে পানির সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নদীর মতোই এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, সে রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটছে। পিচঢালা মসৃণ সড়ক, খানাখন্দক খুবই কম। আশেপাশের দৃশ্য বদলাচ্ছিল একটু পরপরই। কখনো পাহাড়ের সারির পাশ দিয়ে ছুটছি, সঙ্গে ঘন গাছপালা। আবার কখনো পাহাড়গুলো দূরে সরে যাচ্ছিল, সামনে চলে আসছিল গাছের সারি আর ঘন ঘাসের জমি।

শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক যেতে লাগলো প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো সময়। র‌্যাম্পো চেকপোস্ট থেকে পাসপোর্ট ও পারমিট পেপারে এন্ট্রি সিল নিতে বেশি সময় লাগেনি। এখান থেকে পারমিট না নিলে গ্যাংটক গিয়ে কোনো হোটেলেই থাকতে পারবেন না এবং কোথাও ঘুরতেও পারবেন না।

সিকিম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য। এটি জনপ্রিয় একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাত। সিকিমের রাজধানী শহরের নাম গ্যাংটক। সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে, আর এ কারণে পর্যটকেরা ভিড় করেন সিকিমে। তাই আমরাও মনোরম এই রাজ্যে ঘুরতে গিয়েছিলাম।

গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এমজি এমআরজি বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ। এমজি মার্গের রাস্তার মাঝখান দিয়ে সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো, যা দেখতে দুর্দান্ত লাগে। এখানে রয়েছে বসার জায়গা, সুসজ্জিত দোকান-পাট এবং রাস্তাগুলো সব সময় পরিষ্কার-পরিছন্ন। যেন ইউরোপের কোনো শহরে এসে পৌঁছেছি। এমজি মার্গের একপাশে মহাত্মা গান্ধীর একটি মূর্তি রয়েছে।

গ্যাংটকের রাস্তায় ধূমপান, আবর্জনা ফেলা এবং থুতু ফেলা আইনত নিষিদ্ধ। রাস্তার মাঝখানের বাগান পরিপূর্ণ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ঝুলন্ত টব ও মাটিতে বপন করা ফুল ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছের সমাহারে। গাছের প্রতিটি ডাল ও পাতায় বিভিন্ন রংবেরঙের লাইটিং করে রাস্তার সৌন্দর্যের মাত্রা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছুদূর পর পর বাগানের মাঝে স্থাপন করা হয়েছে কৃত্রিম ঝর্ণা। বাগানের গা ঘেঁষে দুধারে রাখা বেঞ্চগুলোতে বসে ভ্রমণকারীরা বসে আছে, কেউবা সেলফি তোলায় ব্যস্ত।
গ্যাংটকে রাত্রি যাপনের পর আমরা পৌঁছালাম নর্থ সিকিমের পর্যটন এলাকা ‘লাচুং’–এ। যার অবস্থান উত্তর সিকিমের অন্তর্গত তিব্বতিয়ান বর্ডারের কাছে। সেখানে মাইনাস ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাত্রি যাপন।

উঁচু পাহাড়ি রাস্তায় যখন আমাদের গাড়ি এঁকেবেঁকে চলছে, তখন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখা মিলল পাথুরে স্বচ্ছ হ্রদ। দুপাশে পাহাড় আর মাঝে বয়ে চলা হ্রদের পানির গভীরতা না থাকলেও আছে স্রোতের তীব্রতা। স্বচ্ছ নীলাভ জলের খরস্রোতা লেকের মাঝে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল পাথর খণ্ডে ধাক্কা খেয়ে নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে এগিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে। মাঝেমধ্যে দেখা মিলছে বন্য বানরের। ওরা উপদলে বিভক্ত হয়ে রাস্তার বাঁকে বাঁকে বসে আছে।

গ্যাংটক থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গ্রামে যেতে সময় লাগলো প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মতো । চারপাশের অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ ও ইয়ামথাং ভ্যালী যাওয়ার পথে স্বচ্ছ নীল পানির ঝরনা মনকে যেন প্রশান্তি এনে দেয়।

সেখানে সুবিশাল বরফের আস্তরণ, তুষারপাতের অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। যা কিনা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সাদা বরফে আচ্ছাদিত থাকার আকর্ষণই মূলত আমাদের পর্যটক বানিয়ে এত দূর টেনে নিয়ে এসেছে। যেখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গখ্যাত খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালির উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৪৭৬ ফুট। বরফ আচ্ছাদিত রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বড় পশমওয়ালা তিব্বতি গরু বা ইয়াক। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বরফাচ্ছন্ন পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণপিপাসুকে মুহূর্তে মাতাল করে তুলবে।

খাড়া পাহাড়ের উচ্চতায় এ পর্যটন স্থাপনায় পৌঁছাতে প্রতিমুহূর্তে আপনার গায়ের লোম নাড়া দিয়ে উঠবে। পাহাড়ের উঁচু-নিচু সরু রাস্তার বাঁক রীতিমতো এক মরণফাঁদ। যাকে বলে ভয়ংকর সুন্দর। লাচুংয়ে দূর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনা, সূর্যের আলোকরশ্মিতে সুউচ্চ পর্বতের মোহনীয় দৃশ্য আমাদের প্রতিটি পরদে পরদে মুগ্ধ করেছে। শেষ বিকেলে সুউচ্চ পর্বতমালায় সূর্যের আলোক রশ্মি যেন হীরার খনির মতো মনে হয়েছে। পথে যেতে যেতে চোখে পড়লো ছোট-বড় পাহাড়ি ঝরনাসহ নানান দৃশ্য।

শেষবেলায় গ্যাংটকের শপিংমলে ঘুরতে গেলাম। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেরে নিলাম নিজেদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা। এ সময় চোখে পড়ল ছোট ছোট দোকানে নানারকমের পণ্যের পসরা সাজানো। সস্তায় বিক্রি হচ্ছে কাশ্মীরি শাল, চাদরসহ অন্যান্য পণ্য। রাতে হোটেলে ফিরে পর দিন সকালে গ্যাংটক হতে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।  

সকালে নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য দার্জিলিং। গাড়ি চলছে শনশন গতিতে। পুরোটা সময় যেন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে যেতে পারি, তাই জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বেলা একটার দিকে দার্জিলিং পৌঁছালাম। এরপর হোটেলে চেকইন করে বেরিয়ে পড়লাম দার্জিলিং শহর ঘুরতে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দার্জিলিং। মানুষ আর প্রকৃতি মিলেমিশে যেন এখানে একাকার। এখানকার পাহাড়ের গায়ে গায়ে গড়ে উঠেছে জনপদ। চারদিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। হিমালয়ের কোলে অসাধারণ সৌন্দর্যের মেঘের দেশ পাহাড়কন্যা এই দার্জিলিং।

হোটেল রুম থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম। এরপর চিড়িয়াখানা ট্রি গার্ডেন ঘুরলাম। এখানকার দার্জিলিং চা পৃথিবীখ্যাত। অপরূপ পাহাড়ি অঞ্চল, চা–বাগান, পাহাড়ের চারদিকে অসংখ্য ঘরবাড়ি সব মিলিয়ে এ যেন এক সম্মিলিত সমাহার। শহরের রাস্তা কোথাও উঁচু, আবার কোথাও নিচু। মেঘের কণা ভেদ করে আঁকাবাঁকা পথের ধারে পুরো দার্জিলিং শহর। এ যেন এক অন্যরকম অনুভুতি।

দেখতে দেখতে আমাদের ট্যুরের সময় শেষ হয়ে এল। নতুন এক অভিজ্ঞতার ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে চির চেনা বাংলাদেশের পথে রওনা হয়ে গেলাম। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি পাওয়া ছিল। আমার সফরসঙ্গী বন্ধু রাসেল, অমিত ও প্রিতমকে ধন্যবাদ জানাই। তারা না থাকলে হয়তো আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণটা এতোটা রোমাঞ্চকর হতো না।

*লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।