ভ্রমণগল্প
হুটহাট এদিক–সেদিক ছোটাছুটিতে, ডে ট্যুরে আমাদের তেমন প্ল্যান লাগে না কখনোই। বড় হয়ে যাচ্ছি, দায়িত্ব বাড়ছে—এটা একটা বিদঘুটে ফিলিংস। গুটিকয়েকের মনে এ ব্যাপারটা বেশ জোরেশোরেই বাসা বেঁধেছে। তাই বারবার সামনে আসতে থাকে—দূরে কোথাও ঘুরতে যাব, যেখানে রাত কাটাব। বছরখানেক আগে থেকেই কক্সবাজারে যাওয়ার কথা চলতে থাকলেও হয়ে উঠছিল না কোনোভাবেই।
দুনিয়ায় যে কয়েকটা কঠিন কাজ, তার মধ্যে একটি হলো পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে ট্যুর প্ল্যান করার পর সেটি সবাইকেই নিয়েই শেষ করতে পারা। এবার কক্সবাজার ট্যুর নিয়ে বেশ তাড়া দিচ্ছিল জামশেদ ও মোরশেদ। এরপর শাফায়েত যুক্ত হলো। উদ্দেশ্য একটাই—সবাইকে নিয়ে যাব। বাকি সবাই কোনো না কোনোকিছুর অসিলা দেখিয়ে না যেতে চেয়েছে। এই ট্যুরের পুরো ক্রেডিট তাই এদের।
যাওয়া না–যাওয়ার এই চক্করে যাওয়ার দিন রাতে এক হওয়ার আগে পর্যন্ত শিওর ছিলাম না কে যাচ্ছে কে যাচ্ছে না। দেখা হওয়ার পর দেখলাম, আজম মিসিং। বাস ধরার পালা।
পূরবী ধরলাম। ঘুমাব ভাবলাম। বাসে অন্য আরেকটা গ্রুপের চিল্লাচিল্লিতে ঘুম উধাও। এরপর আমরা কয়েকজন আড্ডা দিতে দিতে বাসের সুপারভাইজার চিল্লিয়ে উঠলেন, এই ডলফিন মোড়, ডলফিন মোড়।
মাথা গোঁজার জায়গা ঠিক করতে এত পরিমাণ সময় নষ্ট হয়েছে এবার, যা আর কোনো কক্সবাজার ট্যুরে আমার হয়নি। তার ওপর ভোরে কক্সবাজারে এত সংখ্যক দালালের উৎপাত! অনেক হোটেল দেখার পর অবশেষে ঠাঁই মিলল গ্র্যান্ড বিচ রিসোর্টে। হোটেল খোঁজার এই পুরো সময়টুকু সঙ্গে ছিল এনাম। এ অভিজ্ঞতা টুকু ভবিষ্যতে ভালো কাজে লাগবে।
হোটেলে ওঠার পর কেউ চায় ঘুমাতে, তো কেউ বলে সৈকতে যাব। ছোটখাটো তর্কযুদ্ধের পর সৈকতেই যাব জিতে গেল। বের হয়ে নাশতা সেরে সৈকতে গেলাম। ২০২০ সালের পর অনেকবার কক্সবাজার যাওয়া হলেও সমুদ্রস্নান আর হয়ে ওঠেনি। এবার মনের কোণে একটি ইচ্ছা জমল, এদের সঙ্গে ভিজব। নিজে ভিজব, আবার কেউ ভিজবে না, সেটি হতে পারে না, তাই দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে ভিজালাম।
দৌড়ালাম, লাফালাম, ছবি তুললাম, বৃষ্টিতে ভিজলাম, ফুটবল খেললাম—সবই হলো সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রবিলাস আর বৃষ্টিবিলাস একসঙ্গে, আহা জীবন! একমুহূর্তের জন্য মনে হলো কত সহজে কিছু খুচরা পয়সা খরচ করে আমরা সুখ অনুভব করতে পারি। সৈকতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে বৃষ্টিতে ভেজা। এসব মুহূর্তের ছবির ভিডিও নেই। মনের কোণে খুব গহিনে জমা থাকবে সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে গায়ে পড়া বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটার অনুভূতি।
ফেরা, জুমা, ঘুম, ঘুম শেষে উঠে রুমে উনো খেলতে খেলতে সেই যে কি গানের আড্ডা। এনামের সঙ্গে আমরা তালবেতালে, ভুল লিরিকসে জমিয়ে তুললাম আরেকটি সন্ধ্যা।
রাতের খাওয়া। এরপর সমুদ্র পারে হাঁটতে যাওয়া। বৃষ্টি। রুমে ফেরা। ঘুম।
পরেরদিন বাসায় ফিরব, হোটেল থেকে চেক আউট করার পালা। আরেকটু সমুদ্র দেখতে যেতে হবে। নাশতা শেষ করে সুগন্ধা পয়েন্টের দিকে গেলাম। আবারও সমুদ্রে ভিজব, ভিজব না—তর্কে আমরা দুই গ্রুপে বিভক্ত। কেউ সমুদ্রে লাফাল, আর কেউ কেউ দূর থেকেই উপভোগ করল।
চেক আউট পর্ব শেষ করে চাঁদের গাড়ি ঠিক করলাম, উদ্দেশ্য শামলাপুর সৈকতে। গাড়ি চলতে শুরু করল। একপাশে পাহাড় আর একপাশে সমুদ্র। গান-আড্ডা দিতে দিতে আমরা এগোতে থাকলাম। গান-আড্ডা, ছবি ও ভিডিওতে মন ভরলেও পেট তো আর ভরে না। পাটুয়ারটেক পৌঁছাতেই খিদের তোড়জোড়। অশান্ত পেটকে শান্ত করতে হবে। পাটুয়ারটেক খাবারের দোকানগুলোর মেন্যু চেক করার পর রীতিমতো আঁতকে ওঠা অবস্থা আমার আর এনামের। কিছু করার নেই, খেতে তো হবেই।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে, পাটুয়ারটেক সৈকতে ঘোরা শেষ করে আমরা আবারও শামলাপুরের দিকে রওনা দেই।
কেউ গাড়িতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে, কেউ ছবি ও ভিডিও, কেউ গানে গানে পুরো পথ চললাম। নেমেই এত পরিমাণ মাছ দেখে সবাই হতবাক। পুরো একটি মাছের রাজ্যে আমরা তখন।
শামলাপুর সৈকতে ঢেউগুলো যেন আমাদের হাসির প্রতিধ্বনি করছিল। কেউ বালুর ওপর নাম লিখছিল, কেউ ছবি বা ভিডিও করছিল; আর কেউ চুপচাপ ঢেউ গুনছিল। বন্ধুত্বের এমন মুহূর্তগুলো আর কখনো ঠিক এমন করে ফিরে আসে না।
এই সৈকত একদম শান্ত। এখানের প্রতে৵ক মানুষ সমুদ্রজীবন যাপন করে। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনা থেকে শুরু করে সেই মাছ দেশের অন্যান্য জায়গায় পাঠানোর সঙ্গে সবাই কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। বাচ্চা থেকে বুড়ো—সবারই দিনের ব্যস্ততম সময় কাটে মাছ নিয়ে।
শামলাপুর দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ফেরার পথে ইনানী ও হিমছড়ি—এসব জায়গায় নামার প্ল্যান থাকলেও সেটি বাদ দিই আমরা। ফেরার জন্য আবার আমাদের সেই চাঁদের গাড়ি। ফিরছি আমরা।
‘এক পাশে পাহাড়, এক পাশে সমুদ্র,
সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবছে অনুরূপ।
আলো-ছায়ার খেলা শেষে, বাতাসে ফেরে ঘ্রাণ,
বাড়ি ফেরার ডাকে বাজে সন্ধ্যার সনদ-গান।’
কক্সবাজারে ফিরে হোটেলের লবিতে রাখা ব্যাগ নিয়ে সন্ধ্যার নাশতা সেরে বাস টার্মিনালে যাওয়ার অটো ধরলাম। টার্মিনালে যেতেই ‘এই বাস সেই বাস’ তর্কে সৌদিয়া ধরলাম।
এক রাত, দুই দিন—অথচ মনে হবে ছিলাম যুগের বেশি। হাসি, দৌড়, সেলফি, সমুদ্রের ঢেউয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সব ক্লান্তি। চোখে রয়ে গেছে সূর্যাস্ত, মনে বাজে সেই শেষ বিকেলের হাসি। সবার মুখে ‘আরেকবার আসব’ সেই অমলিন প্রতিশ্রুতি। এবার ফেরার পালা বাসের জানালা পেরিয়ে দেখি সমুদ্র আমাদের পিছু ডাকছে।
এ সফর শুধু কক্সবাজারের নয়, বন্ধুত্বেরও।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]