রোমাঞ্চ ও রোমান্টিকতার সাঙ্গু

সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) অনুষ্ঠিত ‘শিক্ষা পরিকল্পনা ও উন্নয়ন’ প্রশিক্ষণ কোর্সের অধীনে আমরা ৩৮ জন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা থানচি ঘুরে এলাম। থানচিতে পর্যটকদের জন্য আছে দুটো মূল আকর্ষণীয় ভ্রমণপথ। একটি হলো তমা তুঙ্গী পাহাড়ের শীর্ষ দেশে আরোহণ। আরেকটি হলো সাঙ্গু নদীর বুকে নাও ভাসিয়ে রেমাক্রির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া।

আমরা বান্দরবান থেকে চাঁদের গাড়িতে উঠে থানচির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। আমরা থানচি পৌঁছে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বেলা তমা তুঙ্গী পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। তমা তুঙ্গী পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য হলো, এই পাহাড়ের শীর্ষ দেশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। উত্তর-পশ্চিমে কেওক্রাডাং, পূর্বে বিজয় তাজিংডং আর দক্ষিণ-পশ্চিমে ডিম পাহাড়ের দেখা মেলে। চারপাশে উঁচু পাহাড়ের সমারোহ, তার মধ্যে মানুষের নির্মিত স্থাপনাকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে তমা তুঙ্গী।

তমা তুঙ্গী পাহাড়
ছবি: সংগৃহীত

রাতের বিশ্রাম শেষে আমরা খুব ভোরে সাঙ্গু নদী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ খানিকটা বিরক্তিকর। তবে নৌকা সাঙ্গুর বুকে ভেসে চলতে চলতে কিছুটা এগোতেই প্রকৃতির অপার মুগ্ধতা সবকিছু ভুলিয়ে দিল। দুই পাশে পাথুরে পাহাড়, পাহাড়ের প্রান্তজুড়ে সবুজের হাতছানি। নিশ্চল সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে এক ছিপছিপে তন্বী নদী। পাথুরে নদীতে স্বচ্ছ স্ফটিক জলের ধারা, মাঝেমধ্যে সদা প্রবহমান জলের কুলকুল শব্দ এক অন্য জগতে নিয়ে যায়।
নদীর একেকটি বাঁক পেরিয়ে সামনে চলা মানে যেন রহস্য উপন্যাসের একেকটি পাতা ওল্টানো। প্রতিটি বাঁকেই প্রকৃতি তার নিজস্বতা নিয়ে হাজির হয়েছে। কোথাও উঁচু পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হয় পৌরাণিক যুগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই অনাদিকাল থেকে। কোথাও আবার সবুজ আর হলুদের মিশ্রণে পাহাড়ের বুকে যেন মনে হয় কে যেন রংতুলি দিয়ে অসাধারণ এক স্কেচ সৃষ্টি করেছে। এই যে প্রকৃতিকে নবরূপে উন্মোচন করার রোমাঞ্চের মধ্যে কীভাবে যেন রোমান্টিসিজম এসে ভর করে। তখন ভেতর থেকে প্রিয়জনের উদ্দেশে কে যেন আনমনে গুনগুন করে গাইতে থাকে—
নদীর যেমন ঝরনা আছে
ঝরনার নদী আছে
আমার আছ তুমি শুধু তুমি।

সাঙ্গুর পাড়ে শান্ত নির্জন প্রকৃতি
ছবি: লেখক

এ রোম্যান্টিক পরিবেশে মাঝেমধ্যে দূর পাহাড়ের কোলে আদিবাসীদের ছোট্ট কুঁড়েঘরের দেখা মেলে। এ কুঁড়েঘর অবলোকনের সময় মনের মধ্যে দুটো অনুভূতি জন্ম দেয়। প্রথমে মনে হয়, এদের জীবনে কত কষ্ট। নাগরিক কোনো সুবিধা নেই বললেই চলে। বিদ্যুৎ নেই, টেলিভিশন নেই, অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই, পাকা রাস্তা নেই, বলা যায় নাগরিক জীবনের কোনো সুবিধাই নেই। আবার ওদের সহজ–সরল জীবন দর্শন যেন বলতে থাকে, এই না পাওয়ার মধ্যেই ওদের অনেক কিছু আছে। ওদের জীবনে কৃত্রিমতা নেই, ক্যারিয়ারের গোলকধাঁধা নেই, চাকরির চাপ নেই, প্রমোশনের তাড়া নেই, বসের ঝাড়ি নেই, অফিসের কুটনামি নেই, লোনের ঘানি নেই, একেবারে ছকে বাঁধা সহজ–সরল জীবন। যে জীবনে খাদ্যের সংস্থান হলে সেদিনের মতো আর কোনো চিন্তা নেই। একেবারে বর্তমানকে নিয়েই বেঁচে থাকা, যেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

সাঙ্গু নদীতে নিচু জায়গায় খানিকটা জল জমে আছে, আবার মাঝেমধ্যে অল্প জলের ধারা। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা হালকা জলের ধারায় নৌকা চালানোই দায়। জলে ভেসে যাত্রী নিয়ে নৌকা সামনে এগোতে চায় না। তখন নৌকা থেকে নেমে জলে পা ভিজিয়ে সবাই মিলে নৌকা ঠেলে ওপরে তুলে নিতে হয়। রেমাক্রির দিকে যত এগোতে থাকি, ততই নদীর বুকে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় পাথরের দেখা মেলে। দূর থেকে দেখে মনে হয় এই পাথর ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়া বোধ হয় সম্ভব নয়। তবে পাথরের কাছে যেতেই ঠিকই পথের দিশা মেলে। এ যেন জীবনের জলছবি। সামনের কঠিন পথের বাধা আসলে যারা মাথা ঠান্ডা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, দিন শেষে তারাই জয়ী হয়।

রেমাক্রির পথে সাঙ্গুর অপরূপ সৌন্দর্য
ছবি: লেখক

অবশেষে দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টার নৌযাত্রা শেষে আমরা রেমাক্রি পৌঁছাই। রেমাক্রি হলো ঝরনার স্রোতোধারার একটি বাঁকের অংশ। নাফাকুম থেকে ঝরনার বিগলিত জলের প্রবাহ এ রেমাক্রি এসে পাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে নিচের প্রবাহে সজোরে আছড়ে পড়ে। ফলে নদীর স্রোতোধারায় জল আর পাথরের এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয়।

যাত্রা শেষে রেমাক্রি জয়ের আনন্দে লেখক নিজেই
ছবি: লেখক

যাঁরা রেমাক্রি থেকে নাফাকুম ট্রেকিং করে গেছেন, তাঁদের কাছে জানতে পারি, রেমাক্রি হলো ‘স্বর্গের’ প্রবেশদ্বার। আসল ‘স্বর্গ’ হলো নাফাকুম। রেমাক্রি থেকে ঘণ্টা দুয়েক ট্রেকিং করে সেই স্বর্গে পৌঁছানো যায়। সময়ের অভাবে আমরা স্বর্গের প্রবেশদ্বার থেকেই থানচি ফিরে আসি। তবে বাকি জীবনের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসি এক রোমাঞ্চকর স্মৃতির ভান্ডার।


* লেখক: সুব্রত মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া