মুক্তার শহর ডাকছে পর্যটকদের

দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় দেশ ভারত। প্রতিবছর লাখো পর্যটক ভারত ভ্রমণ করেন। ভারতের ব্যুরো অব ইমিগ্রেশন দপ্তরের হিসাবে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পর্যটক যান। আকাশপথ, সড়কপথ ও রেলপথে খুব সহজেই ভারতে যাওয়া যায়। ভারতের হায়দরাবাদের পর্যটনস্থানগুলো অনেক পর্যটকের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

বিশ্বের অন্যতম পর্যটন নগরী ‘সিটি অব পার্ল’বা মুক্তার শহর হিসেবে খ্যাত ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দরাবাদ। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দিক দিয়েও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর বিশ্বের লাখো পর্যটক হায়দরাবাদ ভ্রমণ করে থাকেন। হায়দরাবাদের পর্যটনকেন্দ্রগুলো অত্যন্ত মনোরম এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অপূর্ব সমন্বয়। হায়দরাবাদ ভ্রমণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। তখন আবহাওয়া ভালো থাকে। সহজেই যেকোনো স্থান ভ্রমণ করা যায়।

২০১৫ সালের ১১ জুলাই ভোরে কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইন্ডিগো বিমানে তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদের উদ্দেশে রওনা হলাম। সকাল আটটার দিকে হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করল। হায়দরাবাদের ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে শামসাবাদে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নামে বিমানবন্দরটি। চালু ২০০৮ সালের মার্চে। সুন্দর ও পরিপাটি একটি বিমানবন্দর। বিশ্বের অন্যতম ১০টি বিমানবন্দরের একটি এটি। হায়দরাবাদের স্থানীয় মানুষ তেলেগু ও উর্দু ভাষায় কথা বলেন। বিমানবন্দরে নেমে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখনকার মতো উবারের ব্যবস্থা তখন ছিল না মনে হয়। বা থাকলেও আমি পরিচিত ছিলাম না।

ভারতের একটি ব্যবস্থা খুব ভালো, সেটা হলো বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনের সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রিপেইড ট্যাক্সির ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানেই যেতে চান, ভাড়া নির্ধারিত, প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যাত্রীর নিরাপত্তা। যেহেতু সরকারি ব্যবস্থাপনায় এটি পরিচালিত হচ্ছে, সুতরাং এই ট্যাক্সিগুলো এবং চালক নিবন্ধিত। সাহস করে নিকটবর্তী একটি শহরের কথা বলে একটি ট্যাক্সি নিলাম। রোজার সময় আল্লাহর রহমতে মুসলিম ও ভালো একজন ট্যাক্সিচালক পেলাম। আমি গাড়িতে উঠে ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কথা বললাম। সে ইংরেজি বোঝে এবং কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তরও দিতে পারে। অল্প সময়ের মধ্যে ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। আমি তাকে সারা দিনের জন্য ভাড়া করলাম এবং বললাম আমাকে হায়দরাবাদের নামকরা দর্শনীয় স্থানগুলো দেখাতে।

হায়দরাবাদ সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। দক্ষিণ ভারতের বৃহত্তম শহর হায়দরাবাদ। শুধু তেলেঙ্গানা নয়, এটি অন্ধপ্রদেশেরও রাজধানী। দুটি রাজ্যের একটি রাজধানী। ভৌগোলিকভাবে শহরটি দিল্লি থেকে ১ হাজার ৫৬৬ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মুম্বাইয়ের ৬৯৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জন এভারেট-হিথের মতে, হায়দরাবাদের অর্থ ‘হায়দারের শহর’ বা ‘সিংহের শহর’। ‘হায়দার’ অর্থ ‘সিংহ’ আর ‘আবাদ’ অর্থ ‘শহর’। খলিফা আলী ইবনে আবী তালিবকে সম্মান জানাতে নামকরণ করা হয়েছিল। যিনি যুদ্ধে সিংহের মতো বীরত্বের কারণে হায়দার নামেও পরিচিত ছিলেন। ইসলামি স্থাপত্যের পণ্ডিত অ্যান্ডু পিটারসনের মতে, হায়দরাবাদ আসলে বাগানের শহর। কুতুবশাহি রাজবংশের পঞ্চম সুলতান মুহম্মদ কুলি কুতুবশাহের আমলে ১৫৯১ সালে হায়দরাবাদ নগরীর গোড়াপত্তন হয়েছিল।

নেহরু জুওলজিক্যাল পার্ক

ট্যাক্সিচালক প্রথমে আমাকে নিয়ে গেল নেহরু জুওলজিক্যাল পার্কে। ১৯৬৩ সালে চিড়িয়াখানাটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সোমবার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে। সকাল ৯টার পরপরই পৌঁছে গেলাম চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানার প্রবেশপথে সুন্দর মনোরম গেট রয়েছে। একদিক দিয়ে ঢুকতে হয় এবং অন্যদিক দিয়ে বের হতে হয়। গেটের মাঝখানে লেখা রয়েছে ‘নেহরু জুওলজিক্যাল পার্ক, হায়দরাবাদ’ তার মাঝখানে সিংহের ছবি। চিড়িয়াখানায় বেশ কয়েকটি বাঘ রয়েছে। একসঙ্গে ৩টি বাঘকে মুঠোফোনে ক্যামেরাবন্দি করলাম। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সাদা বাঘ। রয়েছে শিম্পাঞ্জি, সিংহ, হরিণ, গন্ডার, জলহস্তিসহ আরও অনেক প্রাণী।

চার মিনার

নেহরু জুওলজিক্যাল পার্ক দেখে রওনা দিলাম হায়দরাবাদের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত চার মিনার দেখতে। হায়দরাবাদের মুসি নদীর পূর্ব তীরের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ ও সৌধ চার মিনার। সুলতান মুহম্মদ কুলি কুতুবশাহের আমলে ১৫৯১ সালে চার মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। হায়দরাবাদকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতির ক্ষেত্রে চার মিনার বড় ভূমিকা পালন করে। হায়দরাবাদ শহরের পরিকল্পনা করা হয়েছে চার মিনারকে কেন্দ্র করে। এ জন্য চার মিনারের চারপাশে হায়দরাবাদ শহর ছড়িয়ে আছে।

চার মিনার দেখতে বর্গাকৃতির। যার প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ২০ মিটার বা প্রায় ৬৬ ফুট এবং যার মধ্যে চারটি বড় বড় খিলান, যা চারটি রাস্তার নির্দেশক। চার মিনারের প্রতিটি কোনায় স্তম্ভগুলো সুন্দর কারুকার্যখচিত দ্বিস্তর ব্যালকনিবিশিষ্ট মিনার। এক একটি মিনারের উচ্চতা ৪৮.৭ মিটার বা ১৬০ ফুট। প্রতিটি মিনারের মাথায় মুকুটের মতো সুন্দর কারুকার্যখচিত এবং মিনারের চূড়ায় ওঠার জন্য ১৪৯ ধাপসংবলিত প্যাঁচানো সিঁড়ি রয়েছে। চার মিনার গ্রানাইট, চুনাপাথর ও মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। প্যাঁচানো সিঁডি বেয়ে ওপরে উঠলাম। ওপর থেকে আশপাশের ভবনগুলোতে অনেক সুন্দর দেখায়।

সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চার মিনারের ওপরে ওঠা যায়। প্রবেশ মূল্য ভারতীয়দের জন্য ২৫ রুপি এবং বিদেশিদের জন্য ৩০০ রুপি। যদি ক্যামেরা নিয়ে যেতে চান, তার জন্য গুনতে হবে আরও ২৫ রুপি। চার মিনারের চারপাশে একটি বড় বাজার রয়েছে, যা লাদ বাজার নামে পরিচিত। এই বাজারে প্রায় ১৪ হাজার দোকান রয়েছে। লাদ বাজারের চুড়ি, মুক্তার গয়না ও আতর বিখ্যাত।

মক্কা মসজিদ

চার মিনারের পাশেই ৪০০ বছরের একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ রয়েছে। মসজিদটির নাম মক্কা মসজিদ। সুলতান মুহম্মদ কুলি কুতুবশাহ মক্কা থেকে মাটি এনে সেই মাটি দিয়ে ইট তৈরি করে এই মসজিদ নির্মাণকাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব হায়দরাবাদ জয়ের পর এ মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করেন। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৮০ ফুট, প্রস্থ ২২০ ফুট এবং উচ্চতা ৭৫ ফুট। এ মসজিদে একসঙ্গে ১০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটির প্রবেশ দরজায় মার্বেল পাথরের আবরণকৃত আসাফ জাহির মাজার রয়েছে। মসজিদটিতে শান্তির প্রতীক অসংখ্য কবুতর দেখা যায়।

চার মিনার ও মক্কা মসজিদ দেখে রওনা হলাম সালার জং মিউজিয়াম দেখতে। সালার জং মিউজিয়ামে প্রবেশ মূল্য ভারতীয়দের জন্য ২০ রুপি এবং বিদেশিদের জন্য ৫০০ রুপি। যদি ক্যামেরা নিয়ে যেতে চান, তার জন্য গুনতে হবে আরও ৫০ রুপি। শুক্রবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে। অন্যদিনগুলোকে সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

সালার জং মিউজিয়াম হায়দরাবাদ শহরের মুসি নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। এটি ভারতের তৃতীয় বৃহত্তর জাদুঘর। অনেক অমূল্য আর দুষ্প্রাপ্য জিনিসের সমাহার রয়েছে এই জাদুঘরে। নবাব মীর ইউসুফ আলী খান জাদুঘরটি তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ঐতিহাসিক মূল্যবান সব জিনিসপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জাদুঘরে রয়েছে মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ফল কাটার ছুরি, সম্রাট শাহজাহানের তরবারি ও টিপু সুলতানের হাতির দাঁতের চেয়ার। অসংখ্য দামি মণিমুক্তা ও হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ। জাদুঘরের অন্যতম সেরা আকর্ষণ মিউজিক্যাল ওয়াচ। সাড়ে ৩ ফুট লম্বা ও দেড় ফুট চওড়া ঘড়িটিতে প্রতি ঘণ্টার ৩ মিনিট আগে একটি লোক (খেলনা পুতুল) ঘড়ির মধ্য থেকে বের হয়ে আসে এবং যে কয়টা বাড়ে, ঠিক ততগুলো ঘণ্টা বাড়িয়ে আবার ভেতরে চলে যায়। এটা দেখার জন্য জাদুঘরের দর্শকেরা ঘণ্টা বাজার আগেই ঘড়ির সামনে ভিড় করেন এবং অপেক্ষায় থাকেন কখন ঘড়ির মধ্যে থেকে মানুষ (খেলনা পুতুল) বের হয়ে ঘণ্টা বাজাবে। ঘড়িতে একজন কামারকে দেখা যায়, যিনি প্রতি সেকেন্ডে বিরামহীনভাবে হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছেন।

বৃদ্ধ মানুষেরা অনেকেই লাঠি ব্যবহার করে থাকেন। অনেকেই আবার আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বংশপরম্পরায় লাঠি ব্যবহার করেন। সালার জং মিউজিয়ামে রয়েছে বিচিত্র রকমের লাঠির সমাহার। কোনোটার হাতল জীবজন্তুর মাথার আকৃতির, কোনোটা পশুপাখির আবার কোনোটা মানুষ ও প্রাণীর মাথার খুলির আকৃতির। এসব লাঠির বেশ কয়েকটির হাতলে রয়েছে বোতাম। এই বোতাম চাপ দিলে কোনোটা থেকে বের হবে চোয়াল আবার কোনোটার জিহ্বা। কোনোটার কান নড়ে। কোনোটার হাতল সজ্জিত ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে। মিউজিয়ামটিতে রয়েছে আগেকার দিনের যুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের তরবারি, ছুরি, বন্দুক, পিস্তল ও রিভলবার।

সালার জং মিউজিয়ামের ৬টি ব্লক রয়েছে। প্রথম তলার কেন্দ্রীয় ব্লক, পূর্ব ও পশ্চিম ব্লক। ঠিক একইভাবে দ্বিতীয় তলায় কেন্দ্রীয় ব্লক, পূর্ব ও পশ্চিম ব্লক। মিউজিয়ামের সামনে রয়েছে নবাব ইউসুফ আলী খানের একটি মূর্তি এবং এই মূর্তির দুই পাশে দুটি কামান। সালার জং মিউজিয়াম দেখে রওনা দিলাম বিখ্যাত গোলকোন্ডা ফোর্ট দেখতে।

গোলকোন্ডা দুর্গ

হায়দরাবাদের গোলকোন্ডা ফোর্ট বা দুর্গ ভারতের একটি প্রাচীন ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ। গোলকোন্ডা দুর্গ হায়দরাবাদের মূল শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত গোলকোন্ডা দুর্গ খোলা থাকে। প্রবেশ মূল্য ভারতীয় ও সার্কভুক্ত দেশের জন্য ২৫ রুপি এবং বিদেশিদের জন্য ৩০০ রুপি। যদি ক্যামেরা নিয়ে যেতে চান, তার জন্য গুনতে হবে আরও ২৫ রুপি। রাতের বেলায় আলোকসজ্জায় দুর্গটিকে মনোরম দেখায়।

‘গোলকোন্ডা’ শব্দটি এসেছে মূলত গোল্লাকোন্ডা থেকে। তেলেগু ভাষায় ‘গোল্লা’ অর্থ ‘রাখাল’ আর ‘কোন্ডা’ অর্থ ‘পাহাড়’। এই গোল্লাকোন্ডাই লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গেছে গোলকোন্ডা নামে। মঙ্গলা ভরম নামে একটি পাহাড়ের চূড়ায় এই দুর্গ অবস্থিত। এক রাখাল বালক এই পাহাড়ের চূড়ায় পশু চরানোর সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। একসময় খেলার ছলে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বেরিয়ে পড়ে এক দেবমূর্তি। এই মূর্তির কথা কাকাতীয় রাজা প্রতাপ রুদ্রের কানে যায়। রাজা এই স্থানটিকে পবিত্র ও সৌভাগ্য আলয় মনে করে মাটির কিল্লাকে আরও মজবুত করে গড়ে তোলেন এবং নামকরণ করেন গোল্লাকোন্ডা।

কাকাটিয়া শাসনামলে রাজা কৃষ্ণদেব পাহাড়ের পাদদেশে কোন্ডাপাল্লি দুর্গের পশ্চিম ভাগের রক্ষণভাগের জন্য এই দুর্গ তৈরি করেছিলেন। রাজা কৃষ্ণদেবের কন্যা রুদ্রমা দেবী ও প্রপৌত্র প্রতাপরুদ্রের হাতে এর পুনর্নির্মাণ এবং শক্তিশালীকরণ হয়। কুতুবশাহি সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে এবং হিরকখনির জন্য এটি বিখ্যাত। বড় আকারের হিরকগুলে গোলকোন্ডা ডায়মন্ড নামে পরিচিত। এই গোলকোন্ডা দুর্গের ভল্টেই অমূল্য হীরা রত্ন রাখা হতো।

গোলকোন্ডা দুর্গ কমপ্লেক্স চারটি দুর্গের সমষ্টি, যার চতুর্দিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এই দুর্গের মধ্যে ছিল রাজকীয় আবাসন, রানি মহল, দরবার হল, তিনটি মসজিদ, মন্দির, অস্ত্রাগার, বন্দিশালা, হাবশি কামান, উটের আস্তাবল, নাগিনাবাগ, আম্বরখানা ইত্যাদি। এখনো বেশ কয়েকটি কামান পড়ে রয়েছে দুর্গে। ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এক চুক্তি অনুযায়ী দুর্গটি বাহমানি শাসকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাহমানিরা মাটির দুর্গটিকে গ্রানাইট পাথর দিয়ে সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে। বাহমানি সালতানাতের অধীনে ধীরে ধীরে গোলকোন্ডা দুর্গ খ্যাতি লাভ করেছিল। ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এটি কুতুবশাহি রাজবংশের রাজধানী ছিল। দুর্গটি ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয় এবং মোগল শাসক আওরঙ্গজেব যখন হায়দরাবাদ দখল করেন, তখন মোগলদের অধীনে চলে যায়। গোলকোন্ডার দুর্গের মনোরম দৃশ্যের জন্য এখানে অনেক সিনেমা ও নাটকের শুটিং হয়। আমিও একটি তেলেগু সিনেমার শুটিং দেখলাম। গোলকোন্ডা দুর্গ দেখে কুতুবশাহি টম্ব দেখার উদ্দেশে রওনা হলাম।

গোলকোন্ডা দুর্গ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে ইব্রাহিমবাগে কুতুবশাহি টম্ব বা সমাধি অবস্থিত। এখানে তুলনামূলকভাবে পর্যটক কম যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান কুলি কুতুব-উল-মুলক তুর্কমেনিস্তান থেকে তাঁর চাচা আল্লাহ কুলি ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দিল্লিতে আসেন। এরপর তিনি দক্ষিণে চলে যান এবং বাহমানি সুলতান মুহাম্মদ শাহর অধীনে চাকরি নেন এবং একপর্যায়ে ১৫১৮ সালে গোলকুন্ডার জয় করে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সুলতান কুলি কুতুব-উল-মুলক ‘কুতুব শাহ’ উপাধি ধারণ করে গোলকোন্ডায় কুতুব শাহি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। গোলকোন্ডা সালতানাতের অধীনে কুতুবশাহিরা বর্তমান ভারতের কর্ণাটক, অন্ধপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা শাসন করেছিলেন। এই রাজবংশ ১৬৯ বছর (১৫১৮-১৬৮৭) হায়দরাবাদ শাসন করেছিল। কুতুবশাহিরা পারসীয় শিয়া সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের জন্য পরিচিত ছিলেন। কুতুবশাহি রাজবংশের পঞ্চম সুলতান মুহম্মদ কুলি কুতুবশাহ ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে হায়দরাবাদ নগরীর গোড়াপত্তন করেছিলেন।

ইব্রাহিমবাগে বিশাল এলাকাজুড়ে এই কুতুবশাহি টম্ব বা সমাধি অবস্থিত। এখানে কুতুবশাহি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান কুলি কুতুব শাহ, তাঁর ছেলে জামশেদ কুলি কুতুবশাহ, ইব্রাহীম কুলি কুতুবশাহ, মুহম্মদ কুলি কুতুব শাহ, সুলতান মুহম্মদ কুতুব শাহ, মির্জা নিজামউদ্দিন আহমেদ (অসমাপ্ত ছিল), আবদুল্লাহ কুতুব শাহ, আবুল হাসান তানা শাহ, ফাতিমা সুলতান, হায়াত বকসী বেগম, মুহম্মদ শাহ, তারা মতি, প্রিন্স মির্জা মুহম্মদ আমিন, কুলসুম বেগম, হাকিম-১, হাকিম-২–এর সমাধি রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি অজানা সমাধি।

কুতুবশাহি টম্ব বা সমাধি দেখে সেকেন্দ্রাবাদ শহরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। হায়দরাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ শহরকে সংযোগকারী হোসেন সাগর দেখলাম। নামে এটি সাগর হলেও আসলে এটা একটি কৃত্রিম হ্রদ। হায়দরাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ শহরের পানির সমস্যা সমাধান ও সেচের জন্য ইব্রাহিম কুলি কুতুবশাহ ১৫৬২ সালে মুসি নদীসংলগ্ন এই হ্রদ খনন করেন এবং গোলকোন্ডার সুফিসাধক হজরত হোসেন শাহ ওয়ালির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁর নামে হ্রদের নামকরণ করেন ‘হোসেন সাগর’। ১৯৯২ সালে এই হ্রদের মাঝখানে একটি বিশাল গৌতম বুদ্ধের মূর্তি স্থাপন করা হয়। হোসেন সাগরের দৈর্ঘ্য ৩.২ কিলোমিটার, প্রস্থ ২.৮ কিলোমিটার এবং গভীরতা ৩২ ফুট (৯.৮ মিটার)। এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ এটি। হায়দরাবাদের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হোসেন সাগর। রাতের বেলায় আলোকসজ্জার কারণে এটি অনেক সুন্দর দেখায়।
হায়দরাবাদের ঐতিহাসিক স্থান ছাড়াও আরও অনেক সুন্দর সুন্দর পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বর্তমানে হায়দরাবাদের পর্যটকদের কাছে অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান রামুজি ফিল্ম সিটি। প্রকৃতি ও কৃত্রিমতার মিশ্রণে তৈরি এ যেন এক স্বপ্নপুরী। চলচ্চিত্রপ্রেমী পর্যটক হলে তো আর কোনো কথাই নেই। হালের ক্রেজ প্রভাসের ‘বাহুবলী ১ ও ২’, চেন্নাই এক্সপ্রেস, মুন্না ভাই এমবিবিএস, ডার্টি পিকচার চলচ্চিত্রের সেই বিখ্যাত গান উ লা লার শুটিংসহ অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ও নাটকের শুটিং স্পট এই রামুজি ফিল্ম সিটি। তাই রামুজি ফিল্ম সিটি ভ্রমণ না করলে অনেকের কাছে হায়দরাবাদ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তবে রামুজি ফিল্ম সিটি ভালো করে দেখতে হলে কমপক্ষে দুই দিন লাগবে।

গ্রিনেচ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী রামুজি ফিল্ম সিটির স্টুডিও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম স্টুডিও কমপ্লেক্স। প্রায় দুই হাজার একর জমির ওপর এ ফিল্ম সিটি অবস্থিত। হায়দরাবাদ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে এটি। তেলেগু চলচ্চিত্র প্রযোজক রামুজি রাও ১৯৯৬ সালে এই ফিল্ম সিটি নির্মাণ করেন। টিকিটের মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১ হাজার ১৫০ রুপি এবং ছোটদের ৯৫০ রুপি। এ ছাড়া ডিলাক্স কার প্যাকেজে টিকিটের মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২ হাজার ২৫০ রুপি এবং ছোটদের ২ হাজার ৫০ রুপি। ১৮-৫৫ এমএমের ওপরে ডিএসএলআর বা অন্য কোনো দামি ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। তবে বিনা টিকিটে সাধারণ ক্যামেরা ও মুঠোফোন নিয়ে যাওয়া যায়। এখানে টিকিট কেটে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘোরা যায়। রামোজি ফিল্ম সিটির মধ্যে রয়েছে বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, আদালত, জেলখানা, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির। এখনকার সবকিছু চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত, তা নয়। সব বয়সী এখানে গেলে আনন্দ, বিনোদন, থ্রিল আর মজা পাবেন। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইড, শো, থিয়েটার, অ্যাকশন দৃশ্যের ক্যামেরার ম্যাজিক। প্রতিনিয়ত চলছে কোনো না কোনো চলচ্চিত্রের শুটিং। কম বাজেটের চলচ্চিত্র নির্মাতা যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকার দৃশ্য দেখাতে চান, তাঁদের জন্য এটি অদ্বিতীয় শুটিং লোকেশন। প্রতিবছর ১৫ থেকে ১৬ লাখ পর্যটক রামোজি ফিল্ম সিটি দেখতে আসেন।

বাংলাদেশ থেকে সহজেই হায়দরাবাদে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন ও বিমানে কলকাতা। কলকাতা থেকে বাস, ট্রেন ও বিমানে হায়দরাবাদ যাওয়া যায়। বিমানে গেলে কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে। আগে থেকে বিমানের টিকিট কেটে রাখলে ভাড়াও খুব বেশি নয়। আড়াই থেকে তিন হাজার রুপি।

ট্রেনে কলকাতার হাওড়া রেলস্টেশন থেকে হায়দরাবাদের সেকেন্দ্রাবাদ রেলস্টেশনে যাওয়া যায়। ট্রেনে খরচ খুবই কম হলেও সময় লাগে বেশি। সাড়ে ২৬ থেকে ৩০ ঘণ্টা সময় লাগে। পাঁচটি ট্রেন হাওড়া থেকে হায়দরাবাদের সেকেন্দ্রাবাদ যাতায়াত করে। ট্রেনের টিকিট পাওয়া কঠিন। এ জন্য আগে থেকে কেটে রাখতে হয়। পরিবার নিয়ে যেতে চাইলে আগে থেকে হোটেল বুকিং দিয়ে রাখা ভালো। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ভালো আবাসিক হোটেলগুলোতে একটু বেশি ভিড় থাকে।

োজনরসিকদের কাছে হায়দরাবাদ স্বর্গরাজ্য। হায়দরাবাদি বিরিয়ানি ও হালিম জগৎ বিখ্যাত। এ ছাড়া নবাবি কাবাব, জাফরানের সুগন্ধিযুক্ত বিরিয়ানি, ক্রিমযুক্ত হালিম ও ঝুরঝুরে কিমা খুবই বিখ্যাত।

লেখক: বেসরকারি সংস্থা ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর