বেলগ্রেড দুর্গ: শুভ্র শহরের ধূসর প্রান্ত
গাড়ি ধীরেই চলছিল, সেটাও থেমে গেল। গাড়িতে থাকা নিরাপত্তা অফিসারের তাড়া, ‘নামো, নামতে হবে।’ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। সামনে নদী, সাভা ও দানিউবের মিলিত হওয়ার জায়গা। শীতের নির্মল আকাশের দেখা নেই। তীব্র কুয়াশাও নেই, নেই বৃষ্টির ঝাপটাও। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির রেশ থামল কিছুক্ষণ আগে। বেলগ্রেডে আসার পর থেকেই দেখছি মেঘের মন ভার। শীতের এই সময়েও মেঘ–বৃষ্টির এমন খেলা। দিনের অর্ধেক সময় রোদের দেখা মিলছে না। শীতের মাত্রাও তীব্র।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি হয়েছে। তাতে অংশগ্রহণের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে দেখার আয়োজন। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা—স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। সামনের গাড়ি থেকে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়ায় ক্রিভো।
তার দুষ্টুভরা ভ্রু নাচানি,
‘কী খবর?’
তার রোমান্টিক হাসি, তাও যদি হয় কেবল আমারই জন্য! স্বভাবতই মন ও হৃদয়ের বেসামাল অবস্থা। হাসি দিয়ে বোঝাই,
‘সব ভালোই চলছে।’
সার্বিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করছে মিলিচা ক্রিভোকাপিচ। সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ডেলিগেট টিমের দেখভালের সমন্বয় করছেন। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, বয়সও কম, সম্পর্কটা সহজ হতে সময় লাগেনি।
মূলগেট পার হয়ে উপরের দিকে হাঁটতে থাকি। এত দূর এলাম, দুর্গের চূড়া না দেখে ফিরি কীভাবে?
বেলগ্রেডের কেন্দ্রে বেলগ্রেড দুর্গ বা ফোর্টরেস অব বেলগ্রেড, কয়েক শ বছর আগে যা নির্মাণ করা হয়। এ দুর্গেই গড়ে উঠেছে কালেমাগদান পার্ক। ঐতিহাসিক এই স্থাপনার অবস্থান বেলগ্রেডের স্টারি গ্রেড পৌরসভায়। সার্বীয় সংস্কৃতির স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বেলগ্রেড দুর্গ অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৯ সালে। সেই সময় থেকে এর তত্ত্বাবধান করছে সার্বিয়ান সরকার। এটি সার্বিয়ার কয়েকটি সেরা দর্শনীয় স্থানের একটি। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পর্যটনকেন্দ্রটি ভ্রমণ করা যায় টিকিট ছাড়াই, বিনা মূল্যে। প্রতিবছর অন্তত ২০ লাখ দর্শনার্থী বেলগ্রেড দুর্গ ভ্রমণ করেন।
দুর্গ প্রান্তে আমাদের হাঁটাহাঁটি। সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত ট্যুর গাইড রদজান রিসটিচ। হাত উঁচু করে, ডানে বামে হেলেদুলে দুর্গের ইতিহাস বলছেন তিনি। আমরা দেখছি, শুনছি আর হাঁটছি। চকচকে সড়ক, যা এঁকেবেঁকে বেয়ে গেছে উপরের দিকে। আমরা হাঁটছি সেই পথে, সঙ্গে তৈরি হচ্ছে কল্পনার প্রেম মিথ। টিমের পেছনে আমি, আমার বাম পাশে ক্রিভো। মাথা নিচু করে হাঁটছে ক্রিভো, পায়ে পা মিলিয়ে। রোমান্টিক একটা ফিলিংস আসে। সেই কবে যে হেঁটেছিলাম, এমন রোমান্টিক মুডে, সব ব্যস্ততা ফেলে রেখে? কিশোরকালের অনুভূতি আমার। সুন্দরী বান্ধবীর সঙ্গে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া বা গ্রামের মেঠোপথে প্রাইভেট পড়ে ফেরার স্মৃতি! কত সুখের কাল ছিল!
বেলগ্রেড দুর্গটি পাহাড়ের চূড়ায়, যার উচ্চতা প্রায় ১২৫ দশমিক ৫ মিটার। সড়কের পাশে খানিকটা মেঠোপথ। এরপর পাহাড়ের ঢালে আঁকাবাঁকা সড়ক, এই পথ বেয়ে উপরের চূড়া। চূড়াপথ থেকে দেখা যায় পুরো বেলগ্রেড। শীতকালে নিম্নচাপ, এর উপর খানিকক্ষণ আগে হয়ে গেল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। দর্শনার্থীদের সংখ্যাও তাই কম। হাতে গোনা কয়েকজন। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। নিস্তব্ধতা ভাঙতে কয়েকটি পাখির ওড়াউড়ি। শীতকালে পাখি ওড়ে না কি?
পুরো বেলগ্রেড দুর্গটি চার ভাগে বিভক্ত। ডনজি আর গর্ঞ্জি গ্র্যাড নিয়ে দুর্গ। আর অপর দুটি ভাগ নিয়ে বর্তমানে কালেমাগদান পার্ক তৈরি হয়েছে। ডনজি হলো বেলগ্রেড দুর্গের আপার টাউন আর গর্ঞ্জি লোয়ার টাউন। দুর্গের মূল বসতিগুলো অবস্থিত এসব এলাকায়। অবশিষ্ট অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে বেলগ্রেডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালেমাগদান পার্ক।
একটা সময়ে বেলগ্রেড বলতে এই দুর্গকে বোঝানো হতো। পরে দুর্গকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে পুরো শহর। শুরুর দিকে কয়েক শতাব্দী ধরে লোকজন দুর্গের এলাকাতেই বাস করত। প্রাচীন বেলগ্রেডের অনন্য উদাহরণ এই বেলগ্রেড, যা টিকে আছে যুগ যুগ ধরে।
ক্রিভো মজা করে বলে, ‘হাঙ্গেরিয়ান রাজা বেলা-১ তার ছেলেকে বিয়ে দেন সার্বিয়ান রাজকন্যা জেলেনার সঙ্গে। বিয়ের পর উপহার হিসেবে তার ছেলেকে উপহার হিসেবে দুর্গটি দিয়েছিলেন।’ ক্রিভোর সঙ্গে যোগ করি আমি, ‘আমাদের দেশে উপহার হিসেবে ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি আরও কত কী দেওয়া হয়। রাজা–বাদশাহর আমলে দেওয়া হতো রাজ্য উপহার। উপহারের এই চল সব আমলেই ছিল বুঝি!’
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এই দুর্গের গোড়াপত্তন। সেসময় এর নাম ছিল সিঙ্গিদুনাম। থ্রেসিয়ান ও ডেসিয়ান উপজাতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্কোরডিস্কির সেল্টিক উপজাতি। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্কোরডিস্কির সেল্টিক উপজাতি এখানে বসতি গাড়ে। দুর্গের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিকে। পরে সেল্টিকদের কাছ থেকে রোমানরা জয় করে নেয় এই দুর্গ-শহর। এটি হয়ে ওঠে রোমানদের অন্যতম প্রধান সামরিক সীমানা।
তবে মধ্য ইউরোপের আক্রমণের ভয় ছিল রোমানদের। রোমান স¤্রাজ্যকে রক্ষা করতে তারা পাহাড় চূড়ার এ দুর্গ-শহরে বিরাট সৈন্যদলের সমাবেশ ঘটায়। এখানে স্থাপন করে একটি সুরক্ষিত সৈন্যশিবির। কিন্তু পরের সময়গুলো সহজ ছিল না রোমানদের জন্য। ৩৭৮ থেকে ৪৪১ সালের মধ্যে গোথ এবং হুনদের বারবার আক্রমণে তাল হারিয়ে ফেলে তারা। ধ্বংস হয়ে যায় রোমান সৈন্যশিবির।বাইজেন্টাইন স¤্রাট জাস্টিনিয়ান ১৫৩৫ সালের দিকে পুনর্নির্মাণ করেন এ দুর্গটি। হুন সম্রাট আত্তিলার সমাধি রয়েছে দুর্গের নিচে।
বেলগ্রেডকে যে সাদা শহর বলা হয়, তারও মূলে রয়েছে এই দুর্গ। সার্বিয়ান ভাষায় বেলগ্রেডের নাম হলো বেওগ্রাদ। বেশির ভাগ স্লাভিক ভাষায় যার অর্থ হলো ‘সাদা শহর’বা ‘সাদা দুর্গ’। সাদা শহর এবং সাদা দুর্গ বলতে এখানে এই বেলগ্রেড দুর্গকেই বোঝানো হয়। বুলগেরিয়ানরা ৮৭৮ সালে প্রথবারের মতো সাদা শহর বলে উল্লেখ করে এ দুর্গ-শহরটিকে। বহুবার এ দুর্গের দখল ও শাসনভার পরিবর্তন হয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। তিন শতাব্দীতে বুলগেরিয়া, তারপরে বাইজেন্টাইনরা এবং তারপরে আবার বুলগেরিয়ানরা। ১২ শতক পর্যন্ত এটি ছিল বাইজেন্টাইনদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি।
সময়ের সঙ্গে পাল্টাতে থাকে দুর্গে পতাকা ওড়ানোর ইতিহাস। কসোভোর যুদ্ধের ১৩২ বছর পরে সার্বিয়ান রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ দখলে নেয় তুর্কিরা। ১৫২১ সালে তারা এ দুর্গটিও জয় করে নেয়। তুর্কিদের রাজত্ব থাকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত। ১৭ শতকে গ্রেট সার্বিয়ান মাইগ্রেশনের সাক্ষী এ দুর্গ। ১৯ শতকে তুর্কি আমলে দুটি সার্বিয়ান বিদ্রোহও ঘটে যায় বেলগ্রেড দুর্গকে সাক্ষী রেখেই। পরে এসে এটি নতুন উদীয়মান সার্বিয়ান রাষ্ট্রের হাতে পড়ে।
ভূমি থেকে উপরে উঠছি। পাহাড়ের রাস্তার মতো ঢালু। হাঁটতে হাঁটতে আঁশফাঁস লাগে। টিমের বয়স্ক সদস্যদের কেউ কেউ হাঁটা পথে ক্ষান্ত দিয়েছেন, রাস্তার পাশে রাখা বেঞ্চে বসে পড়েছেন। সামনে আরও কিছু দূর যেতেই ক্রিভো হাত তুলে দেখাল সোনালি রঙের মূর্তি। এটি প্রভু যিশুর মা মেরির আইকন মূর্তি। এ দুর্গেই রয়েছে ‘গির্জা অব দ্য ডর্মেশন অব দ্য মোস্ট হোলি মাদার অব গড’, যেটি ক্যাথেড্রাল চার্চ হিসেবেও পরিচিত।
১২ শতকে বাইজেন্টাইন শাসনের সময় নির্মিত হয় এ চার্চ। বাইজেন্টাইন রাজকুমারী ও সার্বিয়ান রানী সিমোনিদা ১৩১৫ সালে বেলগ্রেডে থাকার সময় এ মূর্তির পূজা করতেন। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানালো ক্রিভো, তাদের ধর্মীয় রীতি।
চার্চের সামনেই দেখা মেলে বয়োবৃদ্ধ এক জুটির সঙ্গে। বেবি ট্রলিতে তাদের আদুরে নাতি। চার্চের সামনে তারা জিরোচ্ছেন। বয়স্ক লোকের বয়স ৭০–এর বেশি, সঙ্গে তার স্ত্রী, বয়স ৬০ পার। বৃষ্টিশীতল এই সময়েও তারা ঘুরতে বের হয়েছেন। তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখে হাত তুলে হ্যালো বললেন বয়স্ক নারী, মুখে মিষ্টি হাসি। এগিয়ে গিয়ে আমিও হায় বলি। পরিচিত হই। পুরো পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছেন, থাকেন নিশো শহরে। ছেলে আর ছেলের বউ অন্যদিকে ঘুরছে, তারা নাতিকে নিয়ে এদিকটাতে।
বর্তমানে বেলগ্রেড দুর্গ সার্বিয়ার অন্যতম প্রধান একটি প্রত্ন সম্পদ। এর শৈল্পিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ১৯টি স্মারক মূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে, যা সার্বিয়ান ইতিহাস, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রয়েছে ১৮টি নিবন্ধিত প্রত্নœতাত্ত্বিক নিদর্শন: ঘোড়ার নালার টাওয়ার, মেট্রোপলিটন প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ। গবেষক-শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হন রোমান কাস্ট্রাম, প্রধান প্রহরীদের ভবন, ৬টি স্মৃতিস্তম্ভ স্মারকে। এখানে রয়েছে দুটি জাদুঘর ও দুটি প্রদর্শনী গ্যালারি। তুর্কি শাসনের চিহ্ন হয়ে রয়েছে মেহমেত পাশার সমাধিসৌধ। ভ্রমণপিয়াসী দর্শনার্থীদের জন্য বর্তমানে এখানে তৈরি হয়েছে চারটি রেস্টুরেন্ট এবং কফিশপ।
বৃদ্ধ পরিবারের সঙ্গে কথা শেষ করি। তাকিয়ে দেখি, আর সবাই তখনো ওদিকে হাঁটছে। পাশে দাঁড়িয়ে ক্রিভো।
‘চলো ওদিকে।’
ক্রিভোকে ইশারা করি। ক্রিভো আমার হাত ধরে টান দেয়,
‘ওদিকে নয়, এদিকে চলো।’
একটু দৌড়ের মতো করেই চলে আসি কফিশপে। দুটো কফির অর্ডার দেয়।
বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ার দাবিই যেন রোমান্টিসিজমের ধোঁয়া ওঠা কফি!