অতিথি পাখি দেখতে বাইক্কা বিলে

অতিথি পাখি দেখতে শ্রীমঙ্গলের হাওর বাইক্কা বিলে রওনা দিলাম আমরা পাঁচ বন্ধু। ভোরবেলায় উঠে হাতমুখ ধুয়ে সবাই শ্রীমঙ্গলের চৌমুহনীতে চলে এলাম। সেখানে সকাল সাতটায় শ্যাম রেস্টুরেন্টে চা–নাশতা সেরে দুইটি বাইক নিয়ে রওনা দিলাম বাইক্কা বিলের উদ্দেশে। রুবেল ভাই জিজ্ঞেস করলেন, বাইক্কা বিলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা যায় কি? বললাম, সরাসরি বাইক্কা বিলের সিএনজি নেই, সিএনজিতে করে বরুণার হাজীপুর পর্যন্ত যাওয়া যায়। তারপর সেখান থেকে রিজার্ভ নিতে হবে, না হয় শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সিএনজি রিজার্ভ নিতে হবে। শহর থেকে সিএনজি রিজার্ভ নিলে ভালো হয়, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৮০০ টাকার মধ্যে রিজার্ভ নেওয়া যায়। কথা বলতে বলতে কালাপুর বাজার পার হয়ে চলে এলাম বরুণা রাস্তার মুখে। শ্রীমঙ্গল থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার রাস্তায় কালাপুর বাজার পার হয়ে পশ্চিমে বরুণা হাজীপুরের রাস্তা। সড়কের ডানে–বামে বড় করে সাইনবোর্ড দেওয়া আছে বাইক্কা বিল, বরুণা, হাজীপুর হয়ে যেতে হয়। পাকা রাস্তা আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ পারি দিয়ে চলে এলাম হাওর বাইক্কা বিলে।

বাইক্কা বিলে প্রবেশ করতে ছোট্ট একটি সুন্দর ব্রিজ রয়েছে, ব্রিজ দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রবেশদ্বারে ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে নিলাম। তারপর ভেতরে প্রবেশ করি, দেখতে পাই দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে অতিথি পাখি ও মাছের বিভিন্ন রকম চিত্র ও মাছ–পক্ষীর নামের তালিকা।

তারপর দোতলা টাওয়ারের ছাদে উঠে দেখতে পাই হাওরে নীলপদ্মসহ মাখনা, পানিসিঙ্গারা, পদ্মটোনা, শাপলা, শালুক, শামুক, ঝিনুকসহ জলজ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জলাভূমি। ছাদের ওপর থেকে অপূর্ব–অপরূপা হাওরের দৃশ্য দেখে নিচে নেমে এলাম মূল টাওয়ারে যেতে। মূল টাওয়ারটি তিনতলা বিশিষ্ট, প্রতিটি তলায়ই রয়েছে একটি শক্তিশালী বাইনোকুলার।

প্রবেশদ্বার থেকে মূল টাওয়ার ৫০০ থেকে ৬০০ গজ দূরে। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে প্রবেশ করি, কী সুন্দর মনোরম পরিবেশ, নেই কোনো গগনবিদারী চিৎকার, আছে শুধু পাখির কলতান।

হেঁটে হেঁটে অভয়াশ্রমের ভেতর প্রবেশ করে দেখতে পাই, বাইক্কা বিলে পাখিদের জন্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। করচ গাছে ভরপুর এক কিলোমিটার এলাকা। এই একটি গাছ, যে গাছ জলের সঙ্গে বসবাস করতে পারে সারা বছর। জলের মধ্যে এই গাছ মারা যায় না। বরং এই গাছের আঁকাবাঁকা ডালপালা চারদিকে ছড়ানো–ছিটানো, দেখতে অসম্ভব সুন্দর। এ গাছ, এ প্রকৃতি যে কারও মন কাড়বে মুহূর্তে, আমাদেরও মন কেড়েছে। গাছে নিচে ঝরা পাতাগুলো পড়ে আছে, শুকনো পাতাগুলো খয়েরি রঙের, যেন ফুলের বাগিচা বিছানো মাঠ। প্রভাতে চারদিকে সুনসান নীরব, হেঁটে চলেছি আর শুনতে পাচ্ছি শুকনো পাতার মর্মর শব্দ, পাখির কলতান আহ!

হাওরের মধ্যে এই অভয়ারণ্যে চর্তুদিকে করচ গাছের ঘন জঙ্গল। করচ গাছে ঘেরা এলাকাটি অপূর্ব–অপরূপ সাজে সজ্জিত, সেখানে ছবি না তুললে কি হয়? হয় না। যে যার মতো ছবি তুলে নিলাম। এবার অতিথি পাখি দেখার পালা, সকাল ১০টা বাজে, আমরা আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম টাওয়ারের কাছে। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলা টাওয়ারের ওপর উঠে গেলাম অতিথি পাখি দেখার জন্য। বাইনোকুলার দিয়ে পাখি দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে, কচুরিপানা পাখিরা বসে থাকে খাদ্য সংগ্রহ করতে, এদের খালি চোখে দেখা যায় না, দেখতে হয় বাইনোকুলার দিয়ে।
আমরা অসংখ্য অতিথি পাখির দেখা পেলাম।

ছোট পানকৌড়ি, পানিকাউড় বা পানকৌড়ি, বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। অতি পরিচিত এই পাখি জলে ডুবসাঁতার দিয়ে মাছ শিকার করে। কখনো জল থেকে উঠে বাঁশ বা গাছের মরা ডালে বসে ডানা শুকায় দল বেঁধে, গ্রামের গাছগাছালির মধ্যে বাঁশবাগানে।

বাইক্কা বিলের জলাভূমিটিতে অন্তত ২০৩ প্রজাতির পাখি রয়েছে, যার মধ্যে ১৫৩ প্রজাতির অতিথি পাখি এবং বাকি ৫০ প্রজাতির স্থায়ী পাখি। সাইবেরিয়া, চীন, হিমালয়, ভারত, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে এখানে।

পাখি, মাছ ও সুন্দর মনোরম নির্জন পরিবেশ দেখতে চলে আসুন বাইক্কা বিলে।

*লেখক: সমীরণ দাশ, কবি, গল্পকার ও সম্পাদক, শ্রীমঙ্গল মৌচাক সাহিত্য পরিষদ