সুখ-দুঃখেই কাটছে মালদ্বীপপ্রবাসীদের জীবন
মালে শহরে এসে পড়লে বাংলায় কথা বলা লোকের অভাব নেই। দু’পা হাঁটলেই দেখা পাবেন কোনো না কোনো বাংলাদেশির। শহরে দেড় লাখ মানুষের প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশি। গলির খাবার হোটেল থেকে শুরু করে রাজপথের বিলাসবহুল হোটেল—সর্বত্রই বাংলাদেশি। ব্যবসা-বাণিজ্য, সবকিছুই অনেকটা প্রবাসীদের দখলে। অনেকে দোকান ভাড়া নিয়ে নিজেরা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ নিজস্ব দোকান দিয়েছেন। সব মিলিয়ে মাত্র ৬ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটারের এ শহরের প্রাণ বলতে গেলে বাংলাদেশিরা। তাঁরা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়ান।
কেমন আছেন এ বাংলাদেশিরা? করোনাকালে কীভাবে চলেছে তাঁদের জীবন? মালের মতো ব্যয়বহুল নগরে টিকে থাকা যেকোনো মানুষের পক্ষেই কঠিন। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশিরা টিকে আছেন। সুখ-দুঃখ সঙ্গী করে তাঁরা কাটিয়ে চলেছেন প্রবাসজীবন।
গত বছর করোনা শুরুর পর বিধিনিষেধ অবস্থায় সবার জীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। কলকারখানা, দোকানপাট—সবই তখন বন্ধ ছিল। মালিক শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন ওই সময়। কিন্তু শ্রমিকদের অনেকে জানান, করোনাকালে কোনো বেতন পাননি তাঁরা। আয়রোজগার ছাড়া তখন বেতন দেওয়া মালিকের পক্ষেও কঠিন ছিল।
বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর কয়েক মাস ধরে মালের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দোকানপাট খুলছে। বাংলাদেশিরা কাজে ফিরেছেন। দুঃসময় কাটিয়ে এখন মোটামুটি ভালো অবস্থা। মালদ্বীপপ্রবাসীদের অবস্থা বোঝাতে এ কথা বলেছেন বেশির ভাগ বাংলাদেশি। তবে ক্ষোভ–হতাশাও আছে অনেক। দালালের মাধ্যমে এসে ঠিকমতো কাজ না পাওয়া, কাজ পেলেও অনিয়মিত বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিয়ে অনেকেই মালের রাস্তার দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।
মালেতে এখন শ্রমিকসংকট, বলছেন অনেক বাংলাদেশি। বিভিন্ন রিসোর্টে শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। মালেপ্রবাসীরা জানান, দুই বছর ধরে বাংলাদেশিদের নতুন ওয়ার্ক পারমিট বন্ধ। এ কারণে কর্মীসংকট তৈরি হয়েছে।
ফেনী জেলা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে মালেতে আছি। করোনা পরিস্থিতির ধকল কাটিয়ে উঠে এখন প্রবাসীরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশিরা অন্য দেশের প্রবাসীদের তুলনায় ভালোই আছেন। শ্রমিকের চাহিদাও আছে। আয়রোজগার এখন ভালো। মাসে সাধারণ শ্রমিকেরা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন।’
কিন্তু কয়েক মাস আগে এ পরিস্থিতি ছিল না। করোনার সময় সব বন্ধ থাকায় অনেকে বকেয়া টাকাপয়সা ঠিকমতো পাননি মালিকের কাছ থেকে। এসব নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ শোনা গেল কয়েকজনের মুখে। কুমিল্লার আবদুল মোমিন জানান, করোনাকালে অনেক কর্মী দেশে পাঠিয়ে দেন মালিক। এ কারণে চাকরি হারান অনেকে। যাওয়ার সময় ঠিকমতো টাকাপয়সা তাঁরা পাননি।
কুমিল্লার দেবীদ্বারের আবদুল লতিফ বলেন, ‘সাড়ে তিন বছর আগে এখানে আসি। কোম্পানি থেকে বেতন ছিল ২০০ ডলার। কিন্তু দালাল বলেছিল বেতন ও সুযোগ-সুবিধা আরও বেশি। এখানে এসে দেখি ভিন্ন অবস্থা। ২০০ ডলার বেতনে হয় না। কোম্পানিকে বললাম, আমার তো পোষাচ্ছে না। কিন্তু চীনা কোম্পানি বেতন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাড়ায়নি, ছুটিছাটাও দেয় না। বাড়তি কাজের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা পূরণ করেনি। তাই ভালো নেই আমি।’
আরেকজন বলেন, প্রবাসীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কষ্টে আছেন। মালেতে এখন বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা কমছে, অন্যদিকে ভারতীয় শ্রমিকের দাম বাড়ছে। একজন ভারতীয় শ্রমিক মালেতে অন্তত ৪০০ ডলার বেতন পান শুরু থেকেই। বাংলাদেশিরা পান ২০০ ডলার থেকে। তা–ও দেখা যায় ১০ মাস কাজ করলে ৫ মাসের বেতন নেই। বেতনের আশায় নিজের জমানো টাকা ভেঙে খেতে হয় বলে দুঃখ করছিলেন কেউ কেউ।
মালদ্বীপপ্রবাসীদের অনেকের ভাষ্য, বাংলাদেশি অনেকের মধ্যে একটু হতাশা নেমে এসেছে। কারণ, মনমতো জীবন যাপন করতে পারছেন না তাঁরা। এক প্রবাসীর ক্ষোভ, ‘আমরা প্রবাসে এসে যতটা অবহেলার শিকার হচ্ছি, কেউ খবর নিচ্ছে না। আমরা এজেন্সির মাধ্যমে এসেছি। ২০০ ডলার বেতনে কী খাব আর বাড়িতে কী পাঠাব? সপ্তাহে দুই দিন কাজ করি। আমাদের ওপর নানা অবিচার নিয়ে পুলিশের কাছে গেলে কাজ হয় না। ওরা মালিকের পক্ষ নেয়।’
টাঙ্গাইলের মোস্তাফিজুর রহমান ছয় বছর ধরে মালেতে আছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে আমার কাজকর্ম নেই। খাবারের কষ্ট। কী করব বুঝতেছি না। কাজ করলে ঠিকমতো টাকা পাই না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের দিকে নজর দিলে ভালো হয়। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, প্রবাসীদের যেন একটু দেখে।’
ফেনীর সোনাগাজীর তরুণ নুরুল আবছার তিন বছর ধরে মালেতে আছেন। চুক্তিতে কাজ করেন। কিন্তু ঠিকমতো টাকা নাকি পান না। তাঁর নাকি বিভিন্নভাবে ১৫ লাখ টাকা খোয়া গেছে। কুমিল্লার হোটেলকর্মী বিল্লাল হোসেন মালেপ্রবাসী পাঁচ বছর। এখানে হোটেল ব্যবসা আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে জানিয়ে বিল্লাল বলেন, মালিকের আয় ভালোই হচ্ছে। ফলে, বাংলাদেশিরাও সংকট কাটিয়ে ওঠে একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছেন।
কুমিল্লার ফয়জুর গাজীর শঙ্কা, নতুন শ্রমিক আনার ভিসাপ্রক্রিয়া আবার চালু হলে দেখা যাবে লোক লাগবে ৫ জন, দালাল নিয়ে আসবেন ১০ জন। এতে দালালদের পোয়াবারো। এক লাখ টাকার ভিসার জন্য তাঁরা নেবেন ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। কিন্তু মালেতে শ্রমিক এনে কাজ দিতে পারবেন না। কাজের জন্য লোকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যেমনটা এখন হচ্ছে।
অবশ্য ভিন্নমতও আছে। বাংলাদেশিদের অনেকে নাকি কাজ করতে চান না। এক দিন কাজ করলে তিন দিন বসে থাকতে চান। আবার উদ্যমী প্রবাসীরও অভাব নেই। ফেনীর সোনাগাজীর খন্দকার ওমর ফারুক ১৫ থেকে ১৬ বছর মালেতে কাটিয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও করছেন। তিনি বলেন, ‘মালেতে ভালোই আছি। বিভিন্ন সংগঠন করছি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন।’
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা মানুষের জীবনেরই অংশ। মালদ্বীপপ্রবাসীদের জীবনও ব্যতিক্রম নয়।