শরীফ সাহেবের মেঘমেদুর সকালটা
৫৫ বছর বয়সী প্রৌঢ় শরীফ সাহেব প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন। লকডাউন উঠে যাওয়াতে বাসার সামনে লেকের পাড়ে মুক্ত বাতাসে অনেক দিন পর নামাজের পর হাঁটতে বেরিয়েছেন। তার প্রৌঢ় স্ত্রী নামাজের পর একটু ঘুমান। তা ছাড়া সদ্য ছেলেটা জার্মানি চলে গেছে বউ নিয়ে। ছেলের জন্যও তার বউয়ের অনেক মন খারাপ। থাকুক সে একটু ঘুমে, কঠিন বাস্তব এড়িয়ে, একটু শান্তিতে।
হাঁটতে হাঁটতে শরীফ সাহেব ভাবছেন, তারই বন্ধু জার্মানিপ্রবাসী আলীর কথা। বহুদিন পিছে পিছে ঘোরাঘুরি করে বিয়ে করেছিল একই ভার্সিটির ৭ বছরের ছোট এক মেয়েকে। কালের পরিক্রমায় সেই মেয়ে আর তার পরিবারের প্রত্যক্ষ সাহায্যে আলী আজকে সফলতার মুখ দেখেছে। মানে, বেকার, হতদরিদ্র আলী কীভাবে ক্যাম্পাসের ডাকসাইটে সুন্দরী লীনাকে পটালো, সেটা শরীফ সাহেবদের কাছে এখনো বিস্ময়।
অনেক ঈর্ষারও কারণ। বড়লোকের মেয়েরা একটু বেকুব টাইপ হয়। বিয়ের পরপর সেই মেয়ে বাবার টাকায় পড়াশোনা করে আলীর পরিবারে বাবার কাছ থেকে এনে বড় বড় চিকিৎসা করে গেল, এমএসসির পর চলে গেল জার্মানি। লীনার আত্মীয়ের সাহায্যে আলী ছোট কাজ করে চলত, তার অকর্মণ্য বড় বোনের দায়িত্বও নিল আলী। দুটা বাচ্চা হয়েছিল আলী-লীনা দম্পতির পরপর। আলীর মা-বাবা, বড় বোন ও ছোট বোনের বিয়ে—সবকিছু নিয়ে প্রায় না খেয়ে থাকার পরিস্থিতি হয়েছিল এ দম্পতির। সে সময় লীনা ভালো একটা চাকরি পেয়ে আলীকেও একই কোম্পানিতে ঢুকিয়ে পুরো সংসারের হাল ধরেছিল। ঘরে-বাইরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তুলে এনেছিল হতদরিদ্র আলীকে বড়লোক আলীর মর্যাদায়। মেয়েদের কীভাবে মর্যাদা দিতে হয়, সে বিষয়ে আলী কিছুই শেখেনি, পরিবারে তেমন পড়াশোনা করেনি আর নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও মানুষ হিসেবে মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি।
ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। আলী যেখানে-সেখানে যেকোনো মেয়ে দেখলেই নোংরা সম্পর্ক করার জন্য পাগল হয়ে যেত। টাকাপয়সা জীবনে আসা শুরু করাতে সুবিধা হয়ে গেল অনেক গত ১১ বছরে। দেশে আলীর বাবা মারা গেলেন গ্রামে। মা অসুস্থ এবং তাকে দেখতে যেতে হবে বলে বছরে ৩ বার দেশে আসা শুরু করল আলী। গড়ে তুলল নিজের দুঃসম্পর্কের মামাতো বোনের সঙ্গে বাজে সম্পর্ক। আলী শরীফ সাহেবের ছোটবেলার বন্ধু। চরিত্র কখনোই ভালো ছিল না কিন্তু লীনার মতো মেয়ে পেয়ে মানুষ এতটা নষ্ট হতে পারে, এটা সবার কাছে একটা বিস্ময়। তবে মনে মনে কিছুটা আনন্দিত হননি তিনি, বলতে পারবেন না। মানে, একে আলী অতিসাধারণ ঘরের ছেলে, এতটা উন্নতি তার আর লীনার মতো এত সাকসেসফুল মেয়ে কী দেখে এর সঙ্গে এ রকম সতীসাধ্বী জীবন যাপন করছে? সব কি তারাই পেয়ে যাবে দুনিয়ায়?
বছর দুয়েক আগে আলী দেশে এল, যথারীতি নোংরা কাজে মেতে উঠল। আলীর চট্টগ্রামে বাড়ি হওয়াতে লীনা বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় থাকত। টাকা হওয়ার পরও বাসের অযোগ্য নিজেদের গ্রামের বাড়ির তেমন কোনো উন্নতি আলী করেনি। প্রতিবার অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বাচ্চাগুলো অসুস্থ হতো। লীনারা ঢাকায় চলে গেলেই আলী ছোট বোনের বাসায় বা হোটেলে নোংরামি করে যেত, ছোট বোন টাকা পায়, টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল। শুধু দুই বছর আগে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় মামাতো বোনের স্বামী দেখে ফেলল আলী আর তার স্ত্রীকে হোটেল থেকে আপত্তিকর অবস্থায় বের হতে। আলী পালিয়ে চলে গেল জার্মানি।
এ ঘটনার আগপর্যন্ত এত বছর ভালোই চলছিল আলীর জীবন। লীনা সব সময় বেশি আয় করলেও একই অ্যাকাউন্টে টাকা থাকত। দেশে পরিবারকে সাহায্য করতে হবে বলে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ছোট বোনের নামে সরিয়েছে সে। বেকুব লীনা সায় দিয়ে গেছে আর বলেছে মুরব্বির দোয়ায় তার বাচ্চারা নাকি খুব ভালো থাকবে। মাত্র ২০-২১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে যে মেয়ের, গত ২৬ বছর হাজার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের সব শখ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে কেন পড়ে থাকবে এক লোকের সঙ্গে? এদের এ রকম প্রতারণার মধ্যেই পড়া উচিত। কিন্তু হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পরপরই আলীর কাজিন লীনাকে সব বলে দিল। সৎ লোকের অভাব এখনো দুনিয়ায় হয়নি। লীনার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে শুনেছেন শরীফ সাহেব। তার অফিসের বড় সাহেব আবার লীনার মামা। মেধা দিয়ে, কাজ দিয়ে সে মামার ধারেকাছেও এত দিন পৌঁছাতে পারেননি। এত দিনে মনে হয় সে সুযোগ এসে গেছে।
প্রায় প্রায় শরীফ সাহেব লীনার মামার কাছে বলতেন, আপনার ভাগনির ব্যবহার খুব খারাপ। আমার বন্ধুকে কুকুরের ছোট সংস্করণ করে ডাকে। সে জন্য আমার বন্ধু তাকে আর চাইছে না। লীনার মামা বড় আদরের কোয়ালিফায়েড ভাগনির জীবনে ঘটে যাওয়া এ রকম অসম্ভব ঘটনায় মানসিক শকে ছিলেন। বলেন, শরীফ আমার সৎ ভাগনি আল্লাহর পথে আছে, কোনো দিন কারও ভালো ছাড়া খারাপ করেনি, নষ্ট স্বামীকে অনেক চেষ্টা করেছে ভালো করার, কিন্তু না পেরে কোভিড মহামারিতে জার্মানির এক আত্মীয়-পরিজনহীন শহরে দুইটা বাচ্চা নিয়ে আর নিজের কাপড় নিয়ে বের হয়ে এসেছে। লম্পট স্বামী সব প্রকাশের পর ঘরে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে কথা বলত। সেই লোকের কথা আমাকে বলতে এসো না। তোমার বন্ধু মানসিকভাবে অসুস্থ কুলাঙ্গার, যার চেহারা দেখলে সৎ লোকের অমঙ্গল হয়।
শরীফ সাহেব তবু বাচ্চারা তো লীনার সঙ্গে থাকে না ইত্যাদি বলে বলে প্রপাগান্ডা চালিয়ে গেলেন। ফেসবুকের কল্যাণে তিনি নিজেও জানেন লীনার সঙ্গেই বাচ্চারা থাকে। বাপের কুকীর্তি দেখে ফেলার পর মাসের পর মাস এক ঘণ্টার জন্যও ছেলে আলীকে দেখতে চায় না। মেয়েটা খুব ইমোশনাল। কিছুদিন থাকে বাপের সঙ্গে। তাদের এত ইনোসেন্ট চেহারা দেখেও নিজের জীবন সুখে আছে মনে করে প্রায়ই তিনি আনন্দে আটখানা হতেন। বানানো নতুন নতুন প্রপাগান্ডা নিয়ে লীনার মামার কাছে ছুটে যেতেন।
গত কয়েক সপ্তাহে কিন্তু ভয় ধরেছে তার মনে। এ যে বিভিন্ন ভিডিও বের হয়েছে অনেক লোকের, আলীর যা স্বভাব, কোনো ভিডিও যদি তার বের হয়েই যায়, তাহলে বন্ধু হিসেবে মুখ দেখাবেন কীভাবে। তাহলে কি তার অনেক দায়িত্ব ছিল, যেটা তিনি পালন করেননি? অবসরের সময় কাছিয়েছে, নিজের ছেলেমেয়ে আছে। আল্লাহ কি তাহলে তার সৎ-অসহায় বান্দা লীনাকে বাঁচিয়ে রাখবেন মাথা উঁচু করে?
তিনি কি…পারতেন না প্রতিবাদ করতে, আলীর সব অনাচারের বিরুদ্ধে তাল না দিয়ে আলীকে বোঝাতে? আলীর সঙ্গে যে বিবাহিত মহিলার বাজে সম্পর্ক, তাকে বোঝাতে যে স্বামী তার মতো মেট্রিক পাস মহিলাকে রানির আসনে রেখেছে, বিদেশি জীবনের মোহে এবং লীনার রক্ত পানি করা গাড়ি-বাড়িতে নষ্ট সম্পর্ক দিয়ে তার কোনো অধিকার থাকতে পারে না এটা বোঝাতে? কিচ্ছু না পারলে নষ্ট লোককে এড়িয়ে যেতে? মৌন প্রতিবাদ করতে? এখন থলের বিড়াল বের হলে লজ্জার অংশ তারও কি হবে না? তার সন্তানের চোখে তাকিয়ে কী বলবেন?
লীনার অসহায় সন্তানও তো আল্লাহর সৃষ্টি। যিনি সবাইকে বানিয়েছেন, সবার দায়িত্বও তো তাঁর। মানুষ মনে করে, দুনিয়ায় বিচার হয় না; কিন্তু আশপাশ দেখে শরীফ সাহেব এতটা কনফিডেন্ট আর থাকতে পারছেন কই?
শরীফ সাহেব এ বয়সে আল্লাহর বিরাগভাজন হতে চান না। শুধু যেন আলীর কোনো কুৎসিত ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে না আসে, এই দোয়া করতে করতেই বাসার পথে রওনা দিলেন তিনি। আকাশটা কেমন যেন ঘোর কালো হয়ে আসছে, এই বুঝি নেমে আসবে বৃষ্টি।
‘দিনের আলো নিভে গেল
রঙের দোকান তোল
ও বেলা গেল
এবার তোমার আপন দেশে চল’