বৃষ্টিমুগ্ধ পরি
আজকে দিনটার শুরু হয়েছে আধো আলো, আধো আঁধারিতে। আকাশে জমেছে একরাশ অভিমানী কালো মেঘ। একটু পরেই যেন নেমে আসবে একপশলা বৃষ্টি। রিমঝিম রিমঝিম সুরে মাতিয়ে দেবে সাবার সারাটা দিন। সুজন, ওর স্বামী আজ খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে কাজে। গরম চায়ে মুখ দিয়ে মুখ পুড়িয়ে। সাবার অনেক অভিমান হয়েছে। আসলে ওদের বিয়ের চার বছর পার হয়ে গেল। অনেকটা সময়। এখন মনে হয় না সুজনের ওর জন্য উথালপাতাল করা ভালোবাসার সবটুকু অবশিষ্ট আছে।
সাবার আজকে ছুটি। অনেক দিন পর পুরো একটা দিন ওর একান্ত নিজের। সুজন চলে যাওয়ার পর আকাশ ভেঙে নেমে এল বৃষ্টি। সাবার মনে হলো একটু খিচুড়ি, ডিমভুনা আর মরিচের ভর্তা বানিয়ে রাখবে। হয়তো খাবে রাতে সুজন এলে বাসায়। তবু এমন মন উদাস করা দিনে সুজনের পছন্দের খাবার না বানালে অপূর্ব দিনটারই আর কী মানে। জানালায় প্রকৃতির জলছবি আকাঁআঁকি চলছে। রাঁধতে রাঁধতে সাবা চলে গেল সেই কোন ছোট্টবেলার বৃষ্টিমুখর কোনো এক দিনে।
ভৈরব নদের পাড়ে এক কলোনিতে জন্ম আর বেড়ে ওঠা সাবার। বিশাল রেলিং দিয়ে ঘেরা থাকত নদীর প্রায় সব দিক। কিন্তু অনেক দূরে একটা ছোট্ট গেট ছিল, যেটা দিয়ে নদীর পাড়ে যাওয়া যেত। নদীর ওপর বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ির বহর ভেসে থাকত। ওই কাঠ দিয়ে কাগজ বানানো হতো। কোনো এক ঝুম বৃষ্টির দুপুরে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাবা চলে গিয়েছিল নদীর পাড়ে। আজকে বাইরে খেলা যাবে না, সারা দিন উদার নয়নে মেঘের খেলা দেখতে হবে, তাই। তারপর গুঁড়ির ওপর হেঁটে হেঁটে প্রায় মাঝনদীতে চলে গেল ও। মাথার ওপর ঝুম বৃষ্টি, পিছল গুঁড়িতে পড়ে পড়ে ভাব। এমন সময় ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু সুজনের চিৎকার ভেসে এল, আর যাস না, সাঁতার জানিস না, নদীতে পড়লে মরে যাবি। তার চেয়ে চল আম কুড়াই। আমের লোভে সুজনের হাত ধরে ফিরে এসেছিল সাবা। সুজনদের গাছের নিচে তখন ওদের মতো আরও অনেক বাচ্চা আম কুড়াচ্ছে। ঝিনুক ঘষে ঘষে ধারালো করে রেখেছে অনেক আগেই সবাই আম ছিলে খাবে বলে।
সাবার বাসার ওপরতলায় থাকত সুজনেরা। সকালে মাঝেমধ্যে সাবা চলে যেত সুজনদের বাসায় চা খেতে। সাবার মা দিত না খেতে চা, কিন্তু সুজনের কান্নাকাটিতে ওর মা সাবাকেও একটু চা দিত। তারপর দুজন বাগানে চলে যেত প্রজাপতি ধরতে।
মাঝেমধ্যে জোনাকি পোকা। গাছে উঠতে খুব ভালোবাসত সাবা। কোনো এক বৃষ্টিনিঝুম দিনে পড়শির জামরুলগাছে উঠে সাপের বাসা দেখেছিল সাবা, হিসহিস শুনে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। নিচে জামরুল কুড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিল সুজন। ভয়ে দুজনের সেকি দৌড় বাসা পর্যন্ত। এদের মনে হয়েছিল সাপ তাড়া করে না বাসায় এসে কামড় দিয়ে যায়।
একটু বড় হতে হতে সাবা আর সুজন, দুজনেরই নিজেদের অনেক বন্ধু হয়ে গেল। তবু বৃষ্টির দিন এলেই সাবার সব সময় মনে হতো এ বুঝি সুজন এসে বলবে, ‘চল আম কুড়াই।’ তারপর স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির গণ্ডি পেরিয়ে কখন তারা বড় হয়ে গেল, নিজেরাই জানে না।
তারপর কোনো এক ঝুম বৃষ্টির দিনে এক গুচ্ছ কদম হাতে সুজন যখন বলেছিল, ছোট্ট এ জীবনের বাকিটুকু কি একসঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যায়? সাবার পৃথিবীজুড়ে তখন বেজেছে রিমঝিম রিমঝিম ভালো লাগা সুর। বিয়ের পরপর ওরা এসে উঠেছে চারতলা বাড়ির চারতলায় আর বাড়িওয়ালা ছাদে বাগান করার অনুমতি দিয়েছেন। সাবা গোলাপ, চেরি আরও অনেক গাছ লাগিয়েছে। শৌখিন বাড়িওয়ালার ছোট্ট একটা কাচঘর আছে, যেটা একসময় গ্রিনহাউস না কী যেন একটা ছিল। কত বৃষ্টির ছুটির দুপুর সাবা আর সুজন এ ঘরে খুনসুটি করে কাটিয়েছে।
সাবা বসে আছে এক কাপ চা হাতে কাচঘরে এখন। রান্না শেষ। আর্দ্র দুচোখ। বেলা একটা বাজে। হঠাৎ দেখল কখন যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সুজন, চায়ের কাপটা তুলে এক চুমুক দিল। তারপর দুষ্টু দুষ্টু হেসে বলল, এই সাবা, বৃষ্টিতে না ভিজে বসে আছিস যে? কত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে এলাম। চল, বৃষ্টিস্নানের পর খিচুড়ি খাব। ও হ্যাঁ, এই নে কদম। অনেক কষ্ট হয়েছে আমার অভিমানী বউয়ের কদম খুঁজে আনতে। তুই তো আমার মাতাল করা আজীবনের ভালোবাসা রে।
সাবা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে বৃষ্টিভেজা ওর জলপদ্মের দিকে। ছোট্ট জীবনটা আরও বড় হলে কি ক্ষতি হতো?