কেউ কারও হয় না

এ কথা নির্ঘাত সত্যি যে কেউ চিরদিন কারও পাশে থাকে না। একটা সময় না চাইতেও চুপিসারে মনের ঘরে কেউ ঢুকে চুপটি করে বসে থাকে। শুরুর দিকে তাকে তাড়াতে গেলেও সে এমন মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে যে তাকে আর বলা হয় না...তুমি যাও।
তারপর শুরু হবে ভালোবাসার যন্ত্রণা। তাকে আপনি শুরুতে সব অধিকার দিতে চাইবেন না, তবু মানুষটা আপনাকে ভালোবেসে এত বিভোর করে রাখবে যে আপনা-আপনি সব অধিকার সে নিয়েই যাবে। আপনি তখন মুগ্ধ হতেই থাকবেন তার ভালোবাসার ক্ষমতা দেখে। আপনার মনে হবে, মানুষটি আরও আগে এল না কেন? পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষের মতো মনে হবে তাকে। দিন দিন আপনি তলিয়ে যেতে থাকবেন তার ভালোবাসায়। বিমুগ্ধতায় কাটবে আপনার দিনরাত। অপেক্ষায় থাকবেন কখন সে ফোন দেয়, মেসেজ দেয়। আপনি আর তখন আপনি থাকবেন না। হারিয়ে যাবেন তার মাঝে। দিন দিন তার পাগলামি বাড়তেই থাকবে আর আপনি প্রশ্রয় দেবেন তার এই পাগলামিকে। কারণ ততক্ষণে আপনি তার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে আছেন।

তারপর আপনি যখন না চাইতেও তলিয়ে যাবেন, তখন হুট করে সে বদলাতে থাকবে এবং বদলাতেই থাকবে। যে মায়ায় বাহুডোরে সে বেঁধেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল একটা ঘরের কিংবা আজীবন পাশে থাকার অঙ্গীকার। সব তার কাছে পানসে মনে হবে। আপনি তখন বিভোর হবেন আর সে বদলাতেই থাকবে। একদিন ফোন, মেসেজে যে মানুষটি আপনাকে অস্থির করে রাখত, সে-ই একদিন নিশ্চুপ নীরব হয়ে যাবে। বদলাতে থাকবে সে তার আপন গতিতে। অথচ তখন আপনি একটা ফোনকলের জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা করবেন। অথবা ফোন দিতে দিতে হয়রান, কিন্তু সে রিসিভ করবে না। কিংবা বলবে নানা ব্যস্ততার কথা। দূরে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ বাহানা ব্যস্ততা। মানুষের যখন আগ্রহ বা ভালোবাসা কমে যায়, তখন দূরে চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততার বাহানা খুঁজে নেয়।

আচ্ছা মানুষ কি সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য কাঁদে। নাকি তার সঙ্গে থাকাকালে স্মৃতিময় মুহূর্ত আর তার প্রতি মায়ার জন্য কাঁদে। এই একই মানুষটি জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষত বুকের গভীরে লেপটে দিয়ে কত সহজেই চলে গেল। অথচ মানুষটির কথা ভেবে রাতে আপনার ঘুম আসে না, ভোর আর রাতের সঙ্গে আপনার সন্ধি হয়। দুচোখ ভরে জলে প্লাবিত হয় শিয়রে থাকা বালিশ। কখনো বিকেলের গোধূলি লগ্নে তাকে হুটহাট মনে হলে বুকটা হু হু করে ওঠে। কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। মায়া এমনই। চলে গেলেও মায়া কাটিয়ে ওঠা সহজসাধ্য নয়।

হারিয়ে যাওয়া মানুষটি আপনাকে যতটা ক্ষত করে যায়, তার চেয়ে বেশি ক্ষত সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পড়লে। চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় সে। অথচ তাকে ধরতে পারা যায় না। এ কষ্ট বুকটা শূন্য করে দেয়। তার কথা আপনার মনে হলে আপনার কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। এককালের চঞ্চল আপনি চুপ হয়ে যান হঠাৎ করে। একটা সময় আপনার প্রিয় মানুষটি আপনার সামান্য ব্যথায় অস্থির হতো, অথচ আজ আপনি ব্যথায় কাতরাতে থাকলেও তার খবর মেলে না। একদিন যেমন পাগল করা ভালোবাসা নিয়ে এসেছিল, ঠিক তেমনি একদিন কারণ না জানিয়েই হারিয়ে যায়।

মানুষটা চলে যাওয়ার পর আপনার কষ্ট দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে। কোথাও থেকে বিরহের গান শুনলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। কোনো বিষাদের কবিতা আপনাকে খুব ভাবায়। তাকে নিয়ে বেড়ানোর জায়গাগুলো দেখলে আপনার চোখে জল আসে।
সময় গড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে মানুষটাকে ঘৃণা করতে না পারলেও তার সঙ্গে কাটানো স্মৃতিগুলোকে বেইমান মনে হয়। চেষ্টা করি মুহূর্তগুলোকে দূরে রাখতে। ফেলে আসা সময়গুলোকে বড় অনাহূত মনে হয়। চাইলে যদি এই স্মৃতি মুছে ফেলা যেত, এমন ভাবনা আসে। মানুষটাকে ভোলার চেষ্টা করতে না চাইলেও স্মৃতিগুলো বারবার বিষণ্ন করে। কেন জানি এই মানুষটাকে তবু ঘৃণা করা যায় না। এত কিছুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধা আসে, ভালোবাসা আসে। মনের মধ্যে তার প্রতি কিছু একটা ব্যাপার থাকে। যা শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, ক্ষমায় আর তার ভালো থাকার প্রার্থনায় মঙ্গল নিহিত থাকে।
সত্যি বলতে কি, এই পৃথিবীতে আসলেই কেউ কারও হয় না। এই বোধটুকু আসতে আসতে মানুষ নিজেকে তলিয়ে ফেলে। একদিন প্রিয় মানুষটি অন্য কারও হয়ে গেছে। অন্য কারও বুকে স্বপ্ন দেখে রোজ রাতে, এই উপলব্ধি আর কষ্ট দেয় না। শুধু কষ্ট দেয়...একদিন এই মানুষটা স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মানুষটা শুধু আমার এবং আমার ছিল।
ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলো হয়তো আর ফিরে আসে না। ফিরে আসার প্রার্থনা অনেকেই করে না। আসলে যারা ছেড়ে যায়, তারা একটা মানুষের হাসিটুকু নিয়ে যায়। মানুষটি খুব একা হয়ে যায়। তখন একাকী মানুষটি জ্যোৎস্না দেখলে নস্টালজিক হয়, বৃষ্টি এলে তার ভাবনায় সে চলে আসে। আসলে তখন সে মানুষটি স্মৃতি মনে করে বারবার মরে।
*লেখক: নিলয় আহমেদ, কুয়েত