সোনালি দিনের একাকিত্ব
আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, জীবনের গোধূলিলগ্নের সোনালি দিনগুলোতে এসে অনেক মা–ই ভরা ব্যস্ততার জীবন থেকে অনেকটা মুক্ত হয়ে সময় কাটে না বলে অনুযোগ ও দুঃখ প্রকাশ করে থাকেন। আসলে একটি মেয়ের জীবনের প্রতিটি স্তরেরই একেকটা সৌন্দর্য ও মাধুর্য আছে। একজন মা কত ছোটাছুটি করে অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর নিজের সন্তানদের, তা সব মায়েরই চেনা জগৎ। দেশে–বিদেশে গরিব–ধনী, এমনকি গ্রামগঞ্জে ও বস্তিতে বসবাস করা মায়েদের একটাই লক্ষ্য থাকে, কী করে তাঁর সন্তানকে লালন–পালন করে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তুলবেন।
এ ক্ষেত্রে অনেকেই তাঁর স্বামী, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি কিংবা গৃহকর্মীদের সাহায্য পেয়ে থাকেন। কিন্তু সর্বোপরি মায়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। মা বলেই হয়তো তিনি এত বড় দায়িত্ব নিয়ে তাঁর সন্তানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। একটি মায়ের সেই ব্যস্ততা ভরা জীবন শেষ হলে এবং সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, হঠাৎই যেন মনে হয়, ‘আমি এখন কী করব? আমার তো এখন আর করার কিছুই নেই। কী করে কাটবে আমার সময়?’ আজকের এ লেখা সেই পরিস্থিতির কিছুটা সমাধান খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায়।
ধরা যাক তিন বাচ্চা নিয়ে বিদেশের মাটিতে এক চাকরিজীবী বাঙালি মায়ের জীবন ছিল ঘরে–বাইরে অত্যন্ত ব্যস্ত। স্বামী-স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে পাঁচজনের সংসার ছিল তাঁদের। গৃহকর্মীর সাহায্য ছাড়াই স্বামী–স্ত্রী মিলে সবদিক সামাল দিতে চেষ্টা করেছেন।
সপ্তাহান্তে ছুটির দুটো দিনও এই মা একটু আরাম করে ঘুমাতে পারতেন না। গাড়িচালক হয়ে ছুটেছেন বাচ্চাদের নিয়ে আরবি ক্লাস, বাংলা স্কুল, নাচের ক্লাস, রিহার্সাল, ফুটবল (সকার), মার্শাল আর্ট, লাইব্রেরি ছাড়াও নানা রকম প্রতিযোগিতায় বাচ্চাদের অংশ নেওয়ার জন্য। সব মিলে যেন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ছিল তাঁর। কাজের ব্যস্ততার জন্য স্বামী তাঁকে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। তাই মোটামুটি একা হাতেই তাঁকে সামলাতে হয়েছে অনেক কিছু।
আজ তিনি তাঁর গোধূলিলগ্নের সোনালি দিনগুলোতে পা রেখেছেন। বাচ্চাদের নিয়ে সেই ভরা ব্যস্ততা না থাকলেও আজ তিনি সত্যিই ব্যস্ত। মহামারির আগে দেশ–বিদেশ বেড়ানো, লোকলৌকিকতা, সামাজিকতা, লেখালেখি, নানা রকম সমাজসেবামূলক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। আর এখন এর অনেক কিছুই করতে না পারলেও তিনি ব্যস্ত। আর তা ছাড়া এই বয়সে নিজের যত্ন নিতেও তো অনেকটা সময় লেগে যায়। দৈনিক এক ঘণ্টা হাঁটা, গোসল, ধর্মকর্ম, হাটবাজার, রান্নাবান্না, বাগানের যত্ন নেওয়া ইত্যাদি নিয়ে সময় যে কেমন করে কেটে যেতে পারে, তা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন এসব কিছু করার জন্য সবার অনুকূল অবস্থা হয়তো নেই। আর্থিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে সবার জন্য হয়তো এগুলো সম্ভব নয়। কিন্তু আর্থিকভাবে সম্ভব না হলেও আমরা নিজেদের পারিপার্শ্বিকতা নিজেরা তৈরি করে নিতে পারি। তবে এর জন্য প্রথমে নিজেকে তৈরি করতে হবে। যেমন আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, তারই আশপাশে আমাদের খুঁজে নিতে হবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার কোনো না কোনো উপায়। ধরা যাক আমি নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিব। কিন্তু আমার দিন তো মোটামুটি চলে যাচ্ছে। আমার আর্থিক অবস্থা হয়তো আমাকে দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেয় না। কিন্তু আমি তো নিজের দেশেই নিজের অথবা আত্মীয়–পরিজনের গ্রামে বেড়াতে যেতে পারি। এই বেড়াতে যাওয়াটা আমার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হবে অত্যন্ত লাভজনক। বেড়াতে গেলে, অর্থাৎ হাওয়াবদল হলে এমনিতেই মানুষের মন ভালো হয়ে যায়, তার ওপর গ্রামের খোলা হাওয়া আর টাটকা তরিতরকারি, ফলমূল, পুকুরের তাজা মাছ নির্ভেজাল তেল, ঘি দিয়ে রান্না খাওয়া এবং পরিবেশ—সব মিলে একটা ইতিবাচক থেরাপির কাজ করে। আমার জানামতে, অবসর জীবনে অনেকেই গ্রামে বসবাস করছেন এবং অনেকেই ৯০ বছর বয়সেও জীবনকে সুন্দর উপভোগ করে চলেছেন। তবে সবার আগে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে হবে। সুষম খাদ্যাভ্যাস ও সামান্য শরীরচর্চা সত্যিকার অর্থে একজনের জীবনধারা বদলে দিতে পারে। আর তখনই জীবনের সোনালি দিনগুলোকে পুরোপুরি উপভোগ করা সম্ভব হবে।
যাঁদের নাতি-নাতনি আছে, তাঁদের জন্য তো আরও সোনায় সোহাগা! সারা বিশ্বে আজ ঘরে ঘরে প্রযুক্তির উপস্থিতি। কাছে না থাকলেও এ প্রযুক্তির বদৌলতে ইচ্ছা করলে প্রায় প্রতিদিনই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কিছুটা সময় কাটানো যেতে পারে। সময় সত্যিই সুন্দর কেটে যেতে পারে, যদি নিজের পছন্দের কোনো কাজ বা শখকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রচেষ্টা করা হয়। রান্না, সেলাই, ছবি আঁকা, বই পড়া, বাগান করা, টেলিভিশন দেখা, সামাজিক যোগাযোগ, লেখালেখি, ধর্মকর্ম; যাঁর যা পছন্দ। প্রযুক্তি আজ গোটা পৃথিবীকে আমাদের কোলে এনে দিয়েছে। এর সহায়তায় ঘরে বসে আজ অনেক কিছুই করা ও শেখা যায়। যাঁদের এখনো জীবনসাথী বেঁচে আছেন, তাঁর সঙ্গ এ সোনালি দিনগুলোকে আরও মধুময় করে তুলতে পারে। এই করোনা মহামারি যেমন আমাদের অনেক কেড়ে নিয়েছে, তেমনি শিখিয়েছেও প্রচুর।
*লেখক: জাহান সৈয়দ মিনা, ওকভিল, অন্টারিও, কানাডা