সুবর্ণ ভূমি

প্রতীকী ছবি

ট্রানজিট চার ঘণ্টা। কিছুক্ষণ বিভিন্ন শপে ঘোরাফেরা করে নির্ধারিত গেটের সামনে বসে আছি। অন্য রকম এক অনুভূতি হয়; যাকে ঠিক আনন্দ বলা চলে না। হয়তো আনন্দের ওপারে কিছু। আর কিছুক্ষণ পরই থাইল্যান্ডের আকাশে উড়াল দিয়ে বাংলাদেশে দুপুরবেলায় ল্যান্ড করব। প্লেনের জানালা দিয়ে দেখব বাংলাদেশের আকাশ, মেঘ আর মেঘের দর্পণে আমার অপেক্ষায় চোখজুড়ানো গাঢ় সবুজ। ল্যান্ডিংয়ের আগে আগে দেখা যায় ছোট ছোট বাড়িঘর। ফসলের মাঠ। আঁকাবাঁকা নদী। জেলেদের মাছ ধরা। স্কুলমাঠে ছাত্রদের খেলা—এসবের মধ্যেই আমার ফেলে আসা কৈশোর মিশে আছে। আমি মানুষ। আমি বেঁচে আছি। এই আনন্দেই আমার মন ভরে যায়। তাই যা ভাবতে ভালো লাগে, তাই ভাবি। যা দেখতে ভালো লাগে, তাই দেখি। যা করতে ভালো লাগে, তাই করি। ঠিক তখনই চার বছর বয়সী ফুটফুটে একটা মেয়ে এসে আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। সে বলে—
আঙ্কেল, কেমন আসেন? আমি এমা।
এমা? কেমন আছি? হ্যাঁ, ভালো। ইয়ে...
ঠিক তখনই তপু পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে।

কেমন আছ, দোস্ত।
আরে কেমন আছি। এই বুঝি আমাদের মামণি। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।
এই যে তোমার ভাবি। আট বছর পর দেশে যাচ্ছি, দোস্ত।
হ্যাঁ, আমিও তো দেশে যাচ্ছি। ভাবি কেমন আছেন?
ভাবি হাসতে হাসতে বলে—
আপনি! ভাইয়া আমি শিপ্রা। আপনার অনেক ছোট। নাম করেই বলেন।
গায়ে চিমটি কেটে মনে হলো না, আমি স্বপ্ন দেখছি না। এভাবে তপুর সঙ্গে দেখা হবে, এ যেন স্বপ্নেরও অতীত। নানান গল্পে সময় গড়াতে লাগল।
অনার্স শেষ করে ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়েছি। সেখানেই তপুর সঙ্গে পরিচয়। প্রায় দুই মাস ক্লাস করার পর হঠাৎ করেই তপু আর ক্লাসে আসে না। ফোন বন্ধ। তপুর এক বন্ধুর কাছে জানতে পাই, ওদের পরিবারে কী একটা সমস্যা চলছে। তপুর সঙ্গে বন্ধুত্ব তখনো ওই পর্যায়ে নয় যে একদিন ওর বাসায় যাব। এভাবেই তপু স্মৃতির মাঝেই স্থির হয়ে রইল। আজ হলো দেখা।
এরই মধ্যে হঠাৎ তপু বলে—
এই শিপ্রা, তোমরা মা-মেয়ে থাকো। আমরা একটু ঘুরে আসি।
শিপ্রা একবার তপুর দিকে আরেকবার আমার দিকে চেয়ে হাসতে লাগল।
কয়েক কদম দূরে গিয়েই বললাম—
দোস্ত, ঘটনা কী? ভাবি হাসছে কেন? আমারে কি বেক্কলের মতো লাগছে?
তপুও হাসতে লাগল।

আরে না, দোস্ত। তুমি আমার চেয়ে অনেক স্মার্ট। বেক্কল তো আমি। সবাই তাই বলে। অনেক দিন পর দেশে যাচ্ছে তো। বুকিং কনফার্ম করার পর থেকেই আনন্দে খ্যাঁক খ্যাঁক করছে।

ঠিকই বলেছ দোস্ত। আমারও একই অবস্থা। দেশে যাওয়া বলে কথা। আচ্ছা, ওসব বাদ। এখন তোমার ঘটনা বলো। ইংলিশ কোর্সের এ অল্প সময়েই আমরা কেমন ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে তোমার উধাও হওয়ার কারণ কী?
কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে তপু বলে, আরে দোস্ত, আমার কাছেই আমার কোনো খোঁজ ছিল না; আর তুমি কীভাবে পাবে আমার খোঁজ।

আচ্ছা ঠিক আছে। নীরবে তপুর সঙ্গে হাঁটছি। অদূরেই এসকেলেটরের সামনের শপ থেকে দুটো ডাব নিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসি। তপু ডাবে কয়েক চুমুক দিয়ে বলে—
দোস্ত, শিপ্রাকে তোমার কেমন লাগছে?
এ আবার কোন ধরনের প্রশ্ন! তপু আসলে কী বলতে চাচ্ছে? বললাম—
হ্যাঁ, ভালোই তো। ভাবি বেশ সুন্দরী।
এর চেয়েও বেশি সুন্দর ওর মনটা। তুমি শুনে অবাক হবে। এই শিপ্রাকে বিয়ে করে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সব হারিয়েছি।
সব হারিয়েছ মানে, তোমরা দুজনের কথা না হয় বাদই দিলাম, মান-অভিমান জগৎজুড়েই আছে। কী দোষ করল চাঁদের মতো ফুটফুটে এই মামণিটা? ভাতিজিকে দেখে তো আমি চোখ সরাতে পারছি না। গোলাপ ফুলকে হার মানায়।
দোস্ত, সবাই কি আর তোমার মতো?
এটুকু বলেই কয়েক টান ডাবের পানি খেয়ে তপু বলে—
শিপ্রা ওর মায়ের সঙ্গে এক-দুই সপ্তাহ পরপর আমাদের বাসায় আসত।
আচ্ছা।

এই যেমন ওর মাকে সহযোগিতা করত। তখন আমার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হব, এমনই একদিন সকালে দেখি শিপ্রা আমার পড়ার ঘরটা পরিষ্কার করছে। আর একটু পরপর ওড়না দিয়ে চোখ মুছছে। ঘর পরিষ্কার করার সময়টায় আমি ড্রয়িংয়ে গিয়ে বসতাম। ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে বললাম, তুমি চলে যাও। আজ আর কিছু করতে হবে না। কারণ, আমি ধরেই নিয়েছিলাম হয়তো কিছু একটা হয়েছে। তাই আজ ওর মন ভালো নেই। এমন তো হতেই পারে।
তারপর?
তারপর আমার কী যে হলো দোস্ত, আর কিছুই ভালো লাগছে না। কয়েক ঘণ্টা পর তখন বিকেল। গৃহকর্মীকে ফোন দিয়ে ওদের বাসায় গেলাম। আমাকে দেখে তো ওরা মা-মেয়ের আত্মা যেন উড়ে গেছে। ধরেই নিয়েছে হয়তো বড় কোনো বিপদ, নইলে আমি কেন যাব ওদের বাসায়। আশ্বস্ত করে বললাম, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। জাস্ট তোমাদের দেখতে এসেছি। ছোট্ট একখানা টিনশেড ঘর। বেশ পরিপাটি। শুধু মা-মেয়ে থাকে। এই ঘর, ওদের আচার-ব্যবহার আর আতিথেয়তা দেখে আমার মুগ্ধতার সীমা নেই।

ডাব শেষ হয়ে গেছে কখন খেয়াল নেই। খালি ডাবটা তপুর হাত থেকে নিয়ে বিনে ফেলে আবার যথাস্থানে এসে বসি।
হ্যাঁ দোস্ত, বলো।

জানতে ইচ্ছা করল ওরা আসলে কারা। কী তাদের পরিচয়। বিভিন্ন আলোচনার ভেতর একে একে সব বিষয় বেরিয়ে এল। ওর বাবা ছিলেন স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক। নদীভাঙনে স্কুলটাসহ ওদের বাড়ি, জমিজমা বলতে গেলে পুরো গ্রামটাই বিলীন হয়ে গেছে। দুই মাস হয় ঢাকায় আসছে। ওর মা বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। ওর বাবারও বয়স হয়েছে। একটা চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে শুরু করেন ভ্যানে করে শাকসবজি কেনাবেচা। জীবন বাঁচানোর তাগিদে মানুষ যা করে আরকি। যেদিন আমাদের বাসায় কাজ করতে গিয়ে শিপ্রা কাঁদছিল, এর আগের দিন ওরা জানতে পারে ওর বাবা ভ্যানটা জমা দিয়ে ফেরার পথে স্ট্রোক করে রাস্তায় পড়ে যান। ওরা মা-মেয়ে যতটুকু সম্ভব খোঁজাখুঁজি করেছে। পরের দিন সকালে থানায় গিয়ে জানতে পারে, এমনই একজনকে ওরা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে আজ সকালে হস্তান্তর করেছে। তখন আমি বললাম, শিপ্রা আমরা কি এতই নিষ্ঠুর? তোমার বাবা মারা গেছেন অথচ একটুও বললে না! চোখ মুছে নিত্যদিনের মতো কাজ করেই চলেছ। তখন মা-মেয়ে দুজনই নিশ্চুপ।
তারপর?
বার কয়েক জিজ্ঞেস করার পর শিপ্রা বলে—
জীবনে যাদের সবই হারিয়ে যায়, এক-আধটু দয়া ভিক্ষা পেলেও যা, না পেলেও তা। এই ছোট্ট ভাড়া বাসাটায় এসে চলছিল কোনোরকম। সন্ধ্যায় মা–বাবা আর আমি...। কষ্টের মধ্যেও সব ভুলে থাকতে চেষ্টা করতাম। তপু ভাইয়া, আপনি ওসব বুঝবেন না।

তপু দীর্ঘক্ষণ নীরব। আমারও আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। তারপর একসময় তপু বলে—
হঠাৎ করে মনটা কেমন করে ওঠে। জীবনে যার হারানোর কিছুই নেই, তার কাছে যেকোনো প্রাপ্তির মূল্য অনেক। মনে হলো, এখানে কী যেন আছে, যা আমার চারপাশের মেয়েগুলোর মধ্যে নেই। কী এক মন কেড়ে নেওয়া ঘ্রাণ। মাটিমাখা মায়া। পানা ঢাকা নদীর জল এমন কিছু। একবার আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ওর গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওদের বাড়ির সামনে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নিবিড় লিচুবাগান। এত ভালো লাগে আমার ওই বাগানটায়, খুব ইচ্ছা করছে ওখানে আবারও যাই। জানি না আমার ওই বন্ধু এখন কোথায়। কী বলব দোস্ত, ওদের বাসায় যেন ঠিক এমনই এক মোহময় ভালো লাগা। তারপর অনেক বিনয়ের সঙ্গে মাকে বললাম। মা খুব বাজে রিঅ্যাক্ট করলেন। অনুরোধ করলাম, মা কারও কাছে বলো না প্লিজ। না, মা আমার অনুরোধ রাখেননি।

কথাটা পরিবারে জানাজানি হয়। বাবা কঠিন ওয়ার্নিং দিলেন। এতে করে নাকি আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। অথচ আমার মামা, খালাম্মা কারও সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কখনো ভালো হতে দেখেনি। আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া দূরের কথা, চাচা আর ফুফুদের আজও চিনি না। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে আমার মা-বাবার ‘মুখ’টা আসলে কী, আর ওই আত্মীয়স্বজন কারা? তারা কোথায়? যদিও আমারই মা-বাবা, কার কাছে আর কী বলি দোস্ত। বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব আজও পাইনি।

প্রতীকী ছবি

ধানমন্ডিতে একটা আর গুলশানে দুইটা। সব মিলিয়ে বাড়ি আমাদের তিনটা। আমার ছোটবেলাতেই বাবা গ্রামের বাড়ির সব বিক্রি করে দিয়েছেন। চাচা, ফুফু কাউকে বাবা সইতে পারতেন না। জানি না কেন। একটা ভয়ংকর ঘটনার পর থেকে বাবা আর কোনো পারমানেন্ট গৃহকর্মীও রাখেন না আমাদের বাসায়।

ভয়ংকর ঘটনা!
হ্যাঁ, তাই বলছি। আমার নানাবাড়ি এলাকার হাফসা নামের ১০-১১ বছর বয়সের একটা মেয়ে থাকত আমাদের বাসায়। মা একদিন মেয়েটাকে খুব মারধর করেছিলেন। কিচেনের দেয়ালে আছাড় মেরে মেরে ওর মাথা-নাক-চোখ থেঁতলে দেন। হাফসাকে হাসপাতালে নিয়ে বাবা ডাক্তারকে হাত করে খুব কৌশলে বিষয়টা চাপা দেন। ঘটনাটা পুলিশ পর্যন্ত আর গড়ায় না। সুস্থ হয়ে এলে বাবা মেয়েটাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। তার পর থেকে আমার খুব ভয় করে।

ও রে সর্বনাশ। এসব কী বলছ দোস্ত!
আমার সঙ্গে যে মেয়েটা জীবন জড়াবে, বলো কেন জড়াবে?
তোমার কাছে সুখে থাকবে। শান্তিতে থাকবে। ছেলেমেয়ে দুজনই একে অপরের কাছে এটাই তো আশা করে।

এবার বলো, কোনো কারণে আমার মা যদি ওর প্রতি এমন আচরণ করে! বরাবরই দেখেছি। মা যেসব মেয়ের সঙ্গে মেশে, ওরা সব মায়াহীন নারী। তারা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। ওদের শিক্ষাদীক্ষা কী আছে কী নেই, তার চেয়েও বড় তাদের স্বামীর পেশা-পদবির অহংকারের খোলস। এই খোলসের ভেতর জীবন হারিয়ে ফেলা নারী ওরা। ওদের মধ্যে আমি কখনো মহান কিছু দেখিনি।

তপুর কথাগুলো বুঝতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমার চিন্তাচেতনার গতি খুবই সরল। জটিল চিন্তা করতে পারি না। জটিল লোকজনের সঙ্গে সম্পর্কও রাখি না। বললাম—
দোস্ত, আমাদের দেশের ওই শ্রেণিটা সম্পর্কে আমি তেমন জানি না।
তোমার জানার কথাও না। কী হবে ওই সব অনাচার জেনে। তারপর কাউকে না জানিয়ে কোর্টে গিয়ে শিপ্রাকে বিয়ে করি। নিরাপত্তার জন্য আলাদা বাসা নিয়ে চলে যাই। আর্থিক অনটনে পড়ি, ইংলিশ কোর্সে যাওয়াও বন্ধ হয়। তৈরি হয় গ্রেটওয়াল। অনেক চেষ্টা করেছি। ওই দেয়াল আজও ভাঙতে পারিনি।
অবাক হয়ে কেবল শুনেই যাচ্ছি।

বছরখানেক আগের কথা। বাবা তখন হাসপাতালে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন যে সুস্থ হওয়ার আর আশা নেই। তোমার এই ভাতিজি তখন পাঁচ বছরের। বাবাকে দেখতে হাসপাতালের কেবিনে এসে দেখি তখন মা আছেন ওখানে। না দোস্ত। আর বলতে পারছি না।

এ সময় আমি তপুর চোখের দিকে তাকাতেও সাহস পাচ্ছিলাম না।
জড়ানো গলায় সে আরও বলে—
লোকে বলে এ যুগের সন্তানেরা মা-বাবার দেখভাল করে না। দোস্ত, বিশ্বাস করো, আমার মা-বাবা তাদের ভালোবাসাগুলো গলা টিপে মেরে ফেলেছে।

ঠিক তখনই আমাদের সিরিয়াল নম্বর কল করা হয়। দ্রুত লাউঞ্জে ঢুকতেই এমা দৌড়ে এসে জাপটে ধরে আমার কাঁধে ঝুলে পড়ে। তপু জোর করে আমার হাত থেকে ছোট্ট ব্যাগটি নিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে আমরা বিমানে উঠে পড়ি।