যাঁরা দেশে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না, তাঁরাই বিদেশে যান, আসলেই কি তাই?
মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যাঁরা প্রবাসে থাকি, তাঁদের নিয়ে নানা কথা বলা হয়। এর অনেক কিছুই আমাদের কানে আসে। সম্প্রতি এমন কিছু কথা শুনতে হলো। ফেসবুক গ্রুপ ‘ক্যানভাসে’ সেদিন এক ব্যক্তি আমাকে শুনিয়ে দিলেন, যাঁরা দেশে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না, তাঁরাই বিদেশে যান। সাধারণত পাগলের প্রলাপে কান দেওয়ার অভ্যাস নেই, তবু কথাটা কিছুক্ষণ ভাবাল। আসলেই কি আপনাদের মাথায় এমন ভাবনা কাজ করে? কারণ, এ রকম মানসিকতার লোকের অভাব কম নেই দেশে। তথাকথিত কিছু ‘শিক্ষিত’দেরও বলতে শুনি, ‘বিদেশে কামলা খাটে, দেশে আইসা ভাব মারে।’ তাঁদের ধারণা, বিদেশে বাঙালিমাত্রই শ্রমিক, এ ছাড়া অন্য কোনো পেশায় আমাদের স্থান নেই।
তাহলে এ বিষয়েই কিছু আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই বলে নিই, করোনাকালীন ইতালিফেরত ‘আই ফা** ইয়োর কান্ট্রি, ফা** ইয়োর কান্ট্রি সিস্টেম’ ভাইকে নিয়ে বলছি না। দেশের প্রতি তাঁর এই রাগ প্রকাশের কিছু কারণ হয়তো ছিল। যেহেতু তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়নি, কাজেই নিশ্চিতভাবে তাঁকে দোষারোপ করতে পারছি না। অনেকেই তাঁর এমন কথাবার্তা এবং এমন কিছু প্রবাসীর ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণের কারণেই এমন মন্তব্য করেন। সবার জ্ঞাতার্থে, তাঁরা ছাড়াও প্রবাসে কোটি কোটি বাঙালির বাস। আজকের লেখায় বরং সব শ্রেণির বাঙালিকেই এক ভেবে যে জাজমেন্টাল মনোভাব আমরা দেখতে পাই, সেটা নিয়েই কিছু বলার চেষ্টা করেছি।
শুরুতেই একটু চিন্তা করতে পারেন, দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক কোথায়? যেকোনো দিক বিবেচনায় নিতে পারেন। শিক্ষার মান থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য সবকিছুই। ‘স্বল্পোন্নত’ বা ‘উন্নয়নশীল’দেশ বলতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই ‘উন্নত’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারবেন না। এই কথাটা মানেন তো? যদি না মেনে থাকেন, তাহলে দয়া করে দেশের বাইরে একটু যান। দুনিয়ার কোনো দেশ না দেখে নিজেকে ‘সকল দেশের সেরা’ ভাবাটা যতটা আবেগের দিক দিয়ে সঠিক, বাস্তবতার দিক দিয়ে ততটাই ভুল।
মূল বক্তব্য বুঝতে হলে এখন আরেকটি বিষয় সহজভাবে কল্পনা করা যাক।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ শহরে আসেন। কেউ কাজের জন্য, কেউ পড়ালেখার জন্য, কেউ ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ইত্যাদি। কেন? কারণ, শহরে যে সুযোগ–সুবিধা আছে, গ্রামে তা নেই। ভিকারুননিসা, হলিক্রস বা নটর ডেম কলেজে শিক্ষার মান আর গণ্ডগ্রামের ‘হাজি নুরুদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়’ ও ‘কলিমুল্লাহ মেমোরিয়াল কলেজে’ এক মানের শিক্ষা প্রদান করা হয় না। সিলেবাস যদি এক হয়ও, শিক্ষকের মান ও যোগ্যতা, ছাত্রছাত্রীর মান, মনমানসিকতা, শিক্ষার পরিবেশ, সুযোগ–সুবিধা কিছুতেই কিছু মিল নেই। এখন যদি সেই গ্রামের কোনো ছেলে নটর ডেমে পড়ালেখা করে এবং আপনি যদি তাঁকে ‘মেধাবী’ বলার পরিবর্তে প্রচার করে বেড়ান যে সে গ্রামে কিছু করতে পারেনি বলেই শহরে এসেছে, তাহলে লোকে আপনাকে কী বলবে সেটা ভেবে দেখেছেন?
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে অনেক চাষি বাপ–দাদার জমি হারিয়ে বা বিক্রি করে শহরে এসে রিকশা চালান। কারণ, গ্রামে এলেই তাঁর করার কোনো সুযোগ–সুবিধা নেই। কিন্তু যদি সেই নটর ডেমে পড়া ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ইউনিলিভার, ব্যাট, নেসলে বা এ–জাতীয় কোনো বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ভালো একটা চাকরি করেন এবং আপনি যদি সেই রিকশাচালক ও এই চাকরিজীবীকে এক কাতারে এনে বলে বসেন, ‘গ্রামে কিছু করতে পারেনি বলেই শহরে গেছে’, তাহলে সে ছোট হলো নাকি আপনি হলেন?
একই ঘটনা প্রবাসীদের ক্ষেত্রেও ঘটছে। যুক্তিও এক। মেলান।
বিদেশে সব শ্রেণির বাংলাদেশি পাওয়া যায়। কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল, কেউ ছোট বা বড় ব্যবসায়ী, কেউ উচ্চপদস্থ কর্মচারী, কেউ পুলিশ, মিলিটারি, কেউ শিক্ষক, কেউ বা অতি সাধারণ কর্মজীবী। সবাই পরিশ্রমী, সবাইকেই নিজের উপার্জনে পেট চালাতে হয়। অনেকেই আছেন অবৈধ অভিবাসী। ৩০, ৩২, ৪০ বছর হয়ে গেছে, দেশে যেতে পারেন না। এখানেই কাজ করেন, সংসার করেন, এখানেই মারা যান। এখন যদি আপনি ধরেই নেন, তাঁদের প্রত্যেকেই দেশে কিছু করতে পারেননি বলেই বিদেশে এসেছেন, তাহলে চলবে?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানই দেখুন না! বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাবেন সেরা এক হাজারের তালিকায়? অথচ বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী এমন সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করছেন, যেগুলো সেরা ১০০, সেরা ৫০, এমনকি সেরা ১০–এর তালিকাতেও আছে। আপনি কি বলতে চান, তাঁরা কেউই বৈশ্বিক মঞ্চে ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখেন না বলেই বিদেশে আরও বড়, আরও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন? দেশের ‘বাশার অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাননি বলেই মাইক্রোসফট, গুগল, টেসলা বা আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানে বড়–মাঝারি পদে কাজ করছেন? যদি কোনো বাংলাদেশি ফুটবলারকে ফ্রান্স বা ব্রাজিলের জাতীয় দলে খেলতে দেখে আপনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় দলে চান্স পায় না বলেই বিদেশি দলে খেলতে গেছে’, সিরিয়াসলিই একটু বলুন, আপনার নিজের কথাবার্তা, নিজের লজিক নিজের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য মনে হবে তখন?
এরপরে আসে আরেক অভিযোগ, ‘যারা প্রবাসী, তারা বেইমান। নিজ দেশ ফেলে বিদেশের গোলামি করছে।’
তা অনেকেই অনেক কারণে প্রবাসী হতে পারেন। তাঁরা দেশকে ঘৃণা করেন বলেই প্রবাসী হয়েছেন এবং আপনার দেশপ্রেম তাঁদের চেয়ে বেশি, এই কথার ভিত্তি কী সেটাও তো বুঝলাম না! বিনা পয়সায় আমেরিকান গ্রিন কার্ড ধরিয়ে দিলে কজন আছেন, যাঁরা ফিরিয়ে দেবেন? অবৈধ পথে বিদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন, এমন বাঙালির সংখ্যা তো লাখ লাখ। এমন অনেক অবৈধ বাঙালিই আছেন, যাঁরা লিগ্যাল হওয়ার জন্য নিজের একটি অঙ্গ খোয়াতেও রাজি। কেন? দেশকে ঘৃণা করেন বলে? না। হয়তো অনেকেরই দেশের জায়গাজমি বেদখল হয়ে গেছে। দেশে ফেরত গেলে নিজের নিকটাত্মীয়রাই খুন করে ফেলবেন। (প্রতি মাসে এমন খবর পত্রিকায় পাওয়া যায়।) হয়তো তিনি দেশে কোনো ক্ষমতাবানের আক্রোশের শিকার। তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করা হয় (এমন অনেক মানুষকে চিনি)। হয়তো এমনিতেই তিনি প্রবাসে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাঁর অধিকার আছে সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের, যেমনটা আপনার আছে। আপনি কোন অধিকারে কাউকে দোষারোপ করেন?
দেশের রপ্তানি করা প্রচুর পণ্যের ক্রেতাই বাংলাদেশি। দেশের মাছ, শাকসবজি, প্রসাধনী যা বিদেশে রপ্তানি করা হয়, এর বেশির ভাগের ক্রেতাই প্রবাসী বাংলাদেশি। যেখানে চার ডলারে ইতালিয়ান গরমেট বিস্কুট পাওয়া যায়, বেলজিয়াম চকলেটে মোড়ানো ইউরোপিয়ান বিস্কুট পাওয়া যায়, সেখানে তাঁরা পাঁচ ডলারে আমাদের দেশের বেলা বিস্কুট, টোস্ট বিস্কুট কেনে, এটা দেশপ্রেম নয়?
প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে হাজার কাজের ভিড়েও বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো, যেমন পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস কিংবা এমনই সব দিবসে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির টানে কিছুক্ষণের জন্য মাতৃভূমির স্মৃতিচারণা, নিজের উত্তরপুরুষদের বাংলা মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা, একে দেশপ্রেম বলবেন না?
আর দেশের প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের ভূমিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে? অথচ যিনি এ কথাটা বলছেন, তিনি নিজেও দেখা যাবে ট্যাক্স দেন না, দিলেও ফাঁকি দেন। ইলেকট্রিক মিটারে কারচুপি করেন। জমি কেনার সময় ট্যাক্স ফাঁকি দিতে ইচ্ছা করেই জমির দাম কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করেন। সরকারি অফিসে নিজের কাজ আদায়ের জন্য ঘুষ দেন। যেখানে পারছেন, যেভাবে পারছেন, দুর্নীতি করে টাকা আয় করছেন। বাড়ি বানানোর সময় অনুমোদিত নকশার তোয়াক্কা না করে ফুটখানেক এদিক–সেদিক অবৈধভাবে নির্মাণ করছেন। ফুটপাত দখল করছেন, কোথাও কোথাও রাস্তা। নদী দখলের ঘটনাও আমাদের দেশে অতিপ্রাচীন ও সাধারণ। আর তিনি কি না প্রবাসের ঘামঝরানো শ্রমিকের ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের সুনাম আছে তাঁরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, পরিশ্রমী, নির্বিবাদী একটি জাতি। বিশ্বের যেকোনো দেশের নামই নিন, পুলিশের রেকর্ড দেখুন, খুব কম বাংলাদেশিই পাবেন অপরাধীর তালিকায়। আর সে তুলনায় তাঁদের নিয়ে কুকথা বলা লোকজন, যাঁরা কিনা দেশে থাকেন, তাঁরাই দেশকে দুর্নীতিতে শীর্ষে নিয়ে গেছেন। না হলে কারা নিল? এলিয়েন নিশ্চয়ই আসেনি দুর্নীতি করতে?
একটা কথা মাথায় রাখুন, বেশির ভাগ প্রবাসী একটি ভিন্ন দেশে একেবারে শূন্য থেকে কিংবা অনেকেই নেগেটিভ (শূন্যেরও নিচে) থেকে যাত্রা শুরু করেন। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি—সবকিছুই বিরুদ্ধ পরিস্থিতি। এরপরও তাঁরা সবকিছু জয় করে সমাজে শুধু টিকেই থাকেন না, প্রতিষ্ঠাও পান। এবং সেটাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ১০০ ভাগ হালাল উপায়ে। কাউকে ঠকিয়ে নয়, জোচ্চুরি করেও নয়, নিজের পরিশ্রম, মেধা আর বুদ্ধির বলে। আর তাঁদের নিয়ে যাঁরা উল্টাপাল্টা কথা বলেন, তাঁরা নিজেদের দেশে, নিজেদের সমাজ–সংস্কৃতির মধ্যে থেকে কোন অশ্বডিম্ব প্রসব করেছেন? প্রতিহিংসা থেকেই কি এমন মনোভাব?