আমরাই বাংলাদেশ
ঘটনা–এক
২০১৮ সাল। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এক সফরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এসেছেন। দাপ্তরিক কাজের শেষে ওনার স্থানীয় প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমের লোকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য একটা সভার আয়োজন করা হয়েছে। একটা স্থানীয় পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। আমার এখনো মনে আছে, ট্রেন থেকে নেমে যখন রাস্তা পার হয়ে সভাস্থলের দিকে যাচ্ছি, তখন রাস্তা দিয়ে চলমান একটা ইউটের (ছোট ট্রাকের মতো একটা পরিবহন) দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। সেই ইউটের পেছনে দোচালা কুঁড়েঘরের মতো করে একটা ছোট বাক্স রাখা। সেই বাক্সের দুই পাশের দেওয়ালে দুটো পোস্টার শোভা পাচ্ছিল। নিচে লেখা ‘হাসিনা নট ওয়েলকাম্ড ইন অস্ট্রেলিয়া।’
এটা দেখার পর থেকে মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমরা এই অজানা–অচেনা দেশে বাংলাদেশকে নিয়ে কী বার্তা দিচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ। শেখ হাসিনা আসছেন বলে সিডনি বিমানবন্দর রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। একদল ওনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে স্লোগান দিয়েছে, অন্যদল ওনাকে দুয়ো দিয়ে স্লোগান দিয়েছে। এমনকি এই দুই দলের মধ্যে ঢাকার রাস্তার মতো পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, হয়েছে বোতল–ছোড়াছুড়ি এবং হাতাহাতি।
আমি শুধু মনে মনে ভাবছিলাম, সিডনির মতো জায়গার বিমানবন্দরে এ ধরনের ঘটনা বিশ্বব্যাপী আমাদের কী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল! কারণ, সিডনিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বসবাস করে। তাদের আসা–যাওয়ার দুয়ার এই সিডনি বিমানবন্দর। আমি নিশ্চিত, তারা অনেকেই বাংলাদেশকে না চিনলেও প্রথমবার চেনার এই অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না এবং অন্যদের সঙ্গে যখন গল্প করবে, তখন বাংলাদেশের এই হিংস্র ছবিটাই আঁকবে।
ঘটনা–দুই
ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। মুহম্মদ জাফর ইকবার স্যার এবং ইয়াসমীন হক ম্যাডাম আসছেন সিডনিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। হঠাৎ শুনি, সিডনির বাংলাদেশখ্যাত লাকেম্বায় কিছু লোক ওনাদের আগমনের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছে। অবশ্য সেটা তখন অতটা হাইলাইট হয়নি। স্যার আর ম্যাডাম দুজনই আমাদের প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। ওনাদের অনাড়ম্বর জীবনপ্রণালি, বিদেশের সুন্দর জীবন, বেশি বেতনের চাকরির প্রস্তাব, নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা পায়ে দলে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত আমাদের সব সময়ই অনুপ্রাণিত করে। আমরাও স্বপ্ন দেখি, একদিন হয়তো আমরাও ফিরে যাব শেকড়ের কাছে। আর এই প্রবাসে এসেও আমরা তাই প্রবাসী প্রজন্মকে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা দিয়ে যাই। আসলে যেকোনো দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে ভালোবাসলে সব দেশেরটাকেই ভালোবাসা যায়।
এরপর স্যার আর ম্যাডামের সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়েছিল ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলে। সেখানে ম্যাডাম প্রবাসী প্রজন্মের উদ্দেশে একটা চমৎকার বক্তব্য দিয়েছিলেন। ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘তোমরা খুবই ভাগ্যবান। প্রবাসে বেড়ে উঠেও বাংলা ভাষা তোমরা শিক্ষা করতে পারছ। আমি কিন্তু পারিনি। আমার বাবার পোস্টিং ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে আমার স্কুলে কোনো বাঙালি মেয়ে ছিল না। আমিই ছিলাম একমাত্র বাঙালি মেয়ে। তাই আমি না চাইলেও আমাকে উর্দু শিখতে হয়েছিল। আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেও আমাদের বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে তোমরা খুবই ভাগ্যবান। কারণ, বাংলা স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান তোমরা পেয়েছে বাংলা ভাষা শিক্ষা করার জন্য। আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। এরপর আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন আমেরিকায় জন্ম নিল, তখনো আমরা একটা বাংলা ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভব করেছি। পরে অবশ্য দেশে ফিরে আসার পর আর সমস্যা হয়নি।’
ঘটনা–তিন
এবার আসি গত কয়েক দিনের ঘটনায়। বাংলাদেশে পাকিস্তান ক্রিকেট দল খেলতে গেছে এবং স্টেডিয়াম ও স্টেডিয়ামের বাইরে বেশ কিছু দর্শক তাদের সমর্থন জানিয়ে জার্সি পরেছে, প্ল্যাকার্ড দেখিয়েছে, স্লোগান দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে এটা ঠিক কিসের আলামত, সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু সেটা নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, সেদিকে একটু আলোকপাত করতে চাই। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ মনে করেন, আমরা পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম। রাজনীতিবিদদের নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে পাকিস্তান ভেঙে গেছে। এতে সাধারণ জনগণের কোনো লাভ হয়নি। আর পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা তো ছিলো রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। তাই যদি কেউ পাকিস্তানের সমর্থনে কাজ করে থাকে, সে ঠিকই করেছিল। তাই তাদের আসলে ‘রাজাকার’ বলার কোনো অর্থ নেই।
এ ছাড়া একদল মানুষও আছে, যারা খেলার প্রসঙ্গ এলেই বলে, খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশানো উচিত নয়। স্বাধীন দেশে যার যে দলকে মন চায়, সেই দলকে সমর্থন করবে। তারা এটাও বলে, এই যে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে বলেই এত কথা হচ্ছে, কিন্তু যদি সেই জায়গায় ভারতকে সমর্থন করত, তাহলে কিন্তু এত কথা হতো না। আর পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়ার পেছনে ওনারা আরও একটা কারণ দাঁড় করান। সেটা হলো, বাংলাদেশ দলের খেলা এতটাই বাজে হয়ে গেছে যে মানুষ বাধ্য হয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে। অনেকেই এগুলোকে বাড়িয়ে আরও একটা কথা বলেন, আরে! রাজনীতিবিদেরা নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান ভাগ না করলে তো আমরা পাকিস্তানেই থাকতাম। সেদিক দিয়েও সমর্থন করা ঠিক আছে। বরং ভারতকে সমর্থন না করাই যুক্তিযুক্ত। ওরা নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য আমাদের দ্বিখণ্ডিত করেছে। তাদের আরও ব্যাখ্যা হলো, ভারত কিন্তু পাকিস্তান বা নেপালের সঙ্গে সীমানা অঞ্চলে গুলি করে মানুষ মারে না। তারা নাকি শুধু বাংলাদেশিদেরই মারার সাহস পায়।
উপসংহার
একটা দেশ মানে শুধুই একটা ভৌগোলিক খণ্ড নয়। তার সঙ্গে জড়িত থাকে হাজার বছরের ইতিহাস। সেদিক দিয়ে আমাদের ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। এতটুকু একটা স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড পেতে আমাদের কতবার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ১৪ বছরের মাথায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ‘বাংলাদেশ’ নামের একটা আলাদা ভূখণ্ড। ভাষার বিরোধ থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নিষ্পেষণের সমাপ্তি হয়েছিল একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে কে কার স্বার্থে সাহায্য করেছিল, সেটা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে এবং হচ্ছেও কিন্তু সেটাই তো আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের বাংলাদেশীয় দোসররা মিলে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল, নির্যাতন চালিয়েছিল তিন লক্ষ মা–বোনের ওপর। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এ বছর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে। এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অনেক কিছুই অর্জিত হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে, সেটাও কি কম? পাকিস্তান আর ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে খুব সহজেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। সুশাসনের অভাব, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়ে এখনো পেরোতে হবে বহু বন্ধুর পথ।
এত কিছুর পরও বাংলাদেশিরা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে, রাখছে প্রতিভার স্বাক্ষর। অস্ট্রেলিয়াতেও স্থায়ীভাবে বসবাস করছে বাংলাদেশিদের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সিডনিতে বাংলাদেশি কমিউনিটি এখন বেশ বড়। এখানে বাংলাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনও করা হয়। আর বহু সংস্কৃতির দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় এইসব উৎসবে। এখানে বাংলাদেশি দ্বিতীয় প্রজন্মকে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য চালু আছে বাংলা ভাষার অনেকগুলো কমিউনিটি স্কুল। সেখানে প্রবাসী প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে এবং ছবি আঁকে এক সুজলা–সুফলা, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বাংলাদেশের। এভাবেই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের নাম।
প্রত্যেক বাংলাদেশি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। বিদেশিরা বাংলাদেশকে চিনবে তাদের আচার, আচরণ, উৎসবের মাধ্যমে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশের সুনাম বিশ্বজোড়া। বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের সততা ও পরিশ্রমের খবর প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যায়। কিন্তু তবু বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক বিদ্বেষের চর্চা, সেগুলোকে কেন্দ্র করে সমাবেশ, মিছিল আমাদের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই দ্বিমত আছে এবং থাকবে, কারণ আমাদের ইতিহাসটা সহজ-সরল নয়। তার প্রকাশটা যদি আমরা আমাদের নিজেদের দাওয়াত বা আড্ডায় সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যখন ইংরেজিতে পোস্টার, ব্যানার বানিয়ে দেশের সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করি, তখন জাতিগতভাবে আমাদের দৈন্যই প্রকাশ পায়।
যা–ই হোক, সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে। আর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশিরা বিশ্বময় তুলে ধরবে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রবাসী প্রজন্ম খুঁজে পাবে শিকড়ের ঠিকানা। আমরা স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের সঙ্গে খেলায় আর অন্য দলকে সমর্থন করবে না কোনো বাংলাদেশি। অনেক দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন এই লেখা লিখছি, তখন খবর পেলাম, বাংলাদেশে প্রমীলা ক্রিকেট দল পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে পরাজিত করেছে। বাংলাদেশের মেয়েরা যেমন সব বাধা–বিপত্তি পেরিয়ে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে, বাংলাদেশও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে।