অভিযোগ
আমার শাশুড়িমা যেদিন আমার নামে স্বামীর কাছে বিচার দিচ্ছিলেন, সেদিন আমিও কৌতূহলবশত আর পাঁচটা বাঙালি মেয়েদের মতো কান পেতে দাঁড়িয়েছিলাম দরজার আড়ালে। তাঁর বলা অধিকাংশ কথার পেছনের সত্যতা ছিল ভিন্ন। আমি তবুও নীরবে সব শুনেছিলাম। অবশ্য খুব করে জানারও ইচ্ছা ছিল আমার স্বামী প্রত্যুত্তরে কী বলেন। হাজার হলেও মা–বাবা ও পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে বিয়ে করেছি আমরা। ভাবনার মধ্যেই তিনি আমাকে আমার নাম ধরেই ডাকলেন। এই প্রথম তাঁর মুখে নিজের নাম শুনে কেমন জানি লজ্জা এসে ভিড় জমাল। তবুও নিজেকে যতটা পারি, ততটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে উপস্থিত হলাম মা–ছেলের সামনে। হঠাৎ অজানা এক ভয়ে আমার বুকের কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছিল। তাঁর শান্ত–শীতল কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
-আমাকে কেন এসব শুনতে হলো?
তাঁর করা প্রশ্নে আমি বাক্হারা হয়ে গেলাম। মনের কোথাও না কোথাও তো ছিল হয়তো খুব করে বকবেন বা রাগ দেখাবেন। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। কী বলব, সেটাই যখন ভাবছি, তখনই আবার শোনা যায়,
-কী হলো?
এবার আমি বেহায়ার মতো হেসে দিলাম। ঠোঁটের কোণে তাঁরও হাসি উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে।
আম্মার করা অভিযোগগুলো সব সত্য নয়, আবার এসবের পেছনেও আছে কিছু ঘটনা, যা আম্মা জানেন না।
-রাতের ওষুধ খেয়ে ঘুমাও, যাও। আর হ্যাঁ, পরে যেন আর কোনো অভিযোগ না আসে তোমার নামে, মনে রেখো।
শাশুড়িমা হয়তো এসবে বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর দু–একটা চড়া কথা আমাকে শোনাবেন কিন্তু ওনার আশানুরূপ কিছুই হলো না। পেরিয়ে গেছে জীবনের অনেকগুলো দিন, মাস ও বছর। সংসারজীবনের এক যুগ পার হলেও এখনো মাঝেমধ্যেই আমার নামে বিশালাকার নালিশ বসে, কিন্তু প্রতিবারের মতো স্বামী আমার তাঁদের আশানুরূপ আমাকে কথা শোনাতে বা আঘাত করতে পারেন না। শ্বশুরবাড়িতে একসময় এক খালাশাশুড়ি বিচার নিয়ে এলেন। তত দিনে আমি দুই সন্তানের জননী হয়ে গেছি।
আমার বউ আমার কাছে ভালো। আর কার কাছে ভালো বা খারাপ সেটায় আমার কিছু যায় আসে না। আমি যদি তাঁর সঙ্গে এত বছর সংসার করতে পারি, তবে আপনাদের কোথায় এত সমস্যা, বুঝতে পারি না।
খালাশাশুড়ির মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল। তখন থেকে শুরু হলো ছেলে তাঁদের নাকি বউয়ের কথায় উঠে বসে, আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়েছে, বউ জাদু করেছে, ছেলের মাথায় বুদ্ধি বলে কিছু নেই। আমি শুনে নীরবে হাসি। যে মানুষ ব্যবসা করে কোম্পানি চালান আর ২০ জনের জন্য আহারের ব্যবস্থা করেন, তাঁর নাকি বুদ্ধি নেই!
মাঝেমধ্যে তাঁর বুকে মাথা রেখে আমি নিজেই অভিযোগ করি, কী দরকার এত ভালোবাসার? আমার হওয়ার জন্য বাকি সবার কাছে নিজেকে ছোট করার? সেদিন বুকের সঙ্গে খুব জোরে চেপে রেখে বলেছিলেন,
–আমি তো দেখি তুমি সবার জন্য কতটা করো, তারপরও তাঁদের মন ভরে না। তাঁদের যুগ ছিল এক রকম, এখন সময় ভিন্ন। তুমি তো সবার মনমতো হতে পারবে না। সম্ভবও নয়। তাই তুমি যেমন আছ, আমার জন্য ভালোই আছ। দায়িত্ব নয়, ভালোবাসা থেকেই ন্যায়–অন্যায় দেখে প্রতিবাদ জানাই। এই যে বুকের টিপটিপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ, যত দিন তা বন্ধ না হয়, আমি এভাবেই তোমার পাশে আছি।
আমার অভিযোগগুলো হারিয়ে গেছে সেদিন থেকেই। কিন্তু তবুও মাঝেমধ্যেই নতুন করে অভিযোগ জানাই ভালোবাসাটা বাড়িয়ে পেতে। নতুন নতুন অভিযোগের খাতা খুলি আর বরাবরের মতোই সেসব ধুয়েমুছে আরও বেশি ভালোবাসায় সিক্ত করেন তিনি আমায়।