আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি
যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন।’
অনুপমের গানের কথার মতো সবটুকু পেলে জীবন সত্যি নষ্ট কি না, জানি না। তবে এটুকু জানি, কেউ তার মতো করে থাকতে চাইলে তাকে তার মতো করে থাকতে দেওয়া উচিত, স্পেস দেওয়া উচিত। কী বিনয়ের সঙ্গে আর্তি নিয়ে বলছে, আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি। স্রেফ আমার মতো থাকতে চাই। সত্যি আমাদের মস্তিস্কে যদি এতটুকু ঘিলু থাকে, তাহলে বোধ হয় বোঝা উচিত, এই কথাগুলোর মর্ম।
সভ্য লোকেরা নাকি অন্যকে দুঃখ দিয়ে কথা বলে না। মানুষ মনে কষ্ট পায়, এমন কোনো কথা বলা সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। মানে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে কাউকে বিব্রত না করাই সভ্যতা। হয়তো আপনারা বলতে পারেন, এটা অনেকটা সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি আমার খুব কাছের মানুষ হন, তাহলে তো আমি প্রশ্ন করতেই পারি। না, পারেন না। যদি না আমি আপনাকে সেই অধিকারটা দিই।
ব্যক্তিগত প্রশ্ন যেমন করা উচিৎ না, তেমনি কে কী করল, তার সমালোচনা করাও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। ধরুন, আপনার কোনো বন্ধু দেখতে কালো বা মোটা, এরকম কাউকে বিয়ে করল, আপনি কী তাকে বলবেন, কি রে এমন কালো ছেলে বর হিসেবে কী করে পছন্দ করলি? র রুচিও বাবা, আমি হলে জীবনেও এমন ছেলেকে বিয়ে করতাম না।
একবার ভেবে দেখেছেন, কারও মুখের ওপর এমন নেতিবাচক কথা বললে তার কেমন লাগতে পারে? হ্যাঁ, আপনার ভালো নাই লাগতে পারে, কিন্তু বিয়েটা তো আপনি করেননি। যে করেছে, তার প্রবলেম হলে তো সে বিয়ে করতই না, এইটুকু সাধারণ ব্যাপার বুঝলে কিন্তু তাকে এমন কথা বলে বিব্রত করতেন না। কাজেই কাউকে কিছু বলার আগে আমরা সাতবার ভাবব, সেটা আদৌ বলা যায় কি না।
কেউ যখন নিজে থেকে তার কষ্টের কথা আপনাকে বলতে চায়, সেটা মন দিয়ে শুনুন। কোনো উপকার করতে না পারেন, অন্তত সেই কথার সঙ্গে নেতিবাচক তাল মেলাবেন না। তাহলে তার মনটা আরও ভেঙ্গে যাবে। নিজেকে খুব অসহায় লাগবে তার। এমন অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। যেমন, আমার এক বন্ধু আছে, সে প্রায়ই তার স্বামীর কথা বলে কান্নাকাটি করে।
আমি চুপচাপ শুনি আর বলি এডজাস্ট করে নে। কিন্তু যখন ও মাত্রাতিরিক্ত খারাপ থাকে, তখন যদি বলি, কেন পরে আছিস, চলে আয় এমন লোকের সঙ্গে থাকা সত্যি কঠিন। তখন দেখি ও নিজে থেকেই আবার ওর স্বামীর ভালো দিকগুলো নিয়ে কথা বলে। কাজেই আমার মনে হয়, কেউ তার আপনজন সম্পর্কে মন্দ কথা শুনতে পছন্দ করে না। তাই কেউ যখন তার কষ্টের কথা বলে হালকা হতে চায়, তাকে তার কথাগুলো বলতে দিন। তার বেদনা আরও বেড়ে যায়, এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘Praise Publicly, Criticism Privately.’ আসলে মন্দ কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগে না তাই সমালোচনা থেকে যদি একেবারে বের হতে না পারি তাহলে অন্তত ওটা আড়ালে করি। এটাও হয়তো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ক্যারেক্টারের মধ্যে পড়ে, কিন্তু সরাসরি কাউকে আঘাত করা থেকে দূরে থাকি, যাকে বলে মন্দের ভালো।
আমাদের মননশীলতায় আধুনিক হতে হবে। আধুনিক মানেই ছোট স্ট্রেইট চুল আর হাতাকাটা জামা নয়। আধুনিক মানে বড় মনের উন্নত মনের মানুষ হওয়া। মানুষ তখনই আধুনিক হয়, যখন তার সমস্তটা জুড়ে একটা পবিত্র আত্মা বিরাজ করে। তার চিন্তা–চেতনায় উদারতা থাকে।
কারও প্রতি আপনার কিউরিসিটি বা উৎসাহ থাকতেই পারে। বিশেষ করে সেই মানুষের প্রতি আমাদের উৎসাহ বেশি থাকে যে তার নিজের সম্পর্কে কখনো অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে না। আপনি যখন বুঝতেই পারছেন, এই মানুষটা নিজের মতো থাকে বা ব্যক্তিগত বিষয় আড়ালে রাখে, তার মানে তাকে অযাচিত প্রশ্ন করা বোকামি।
ধরুন আপনার কোনো বন্ধু বিয়ে করছে না। আপনি দেখছেন সে বিন্দাস আছে। তবুও অতি উৎসাহ নিয়ে বলে বসলেন, এই তুমি কি আর বিয়ে করবা না? নাকি পরিবার থেকে এসব নিয়ে আর ভাবছে না?
সে হয়ত ডিপ্লোম্যাটিক ওয়েতে আপনাকে তার উত্তর দিবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে আপনাকে তার আর ভালো লাগবে না। আপনার প্রতি ন্যূনতম সম্মানটুকু সে হারাবে। কাজেই নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে অন্যকে জানতে চাওয়া উচিত।
আমরা বাঙালিরা প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি সামাজিক। যেমন ধরুন তিন ঘণ্টার জার্নিতে পাশের সিটে বসা সহযাত্রীর নাম কি বাড়ি কই থেকে শুরু করে পুরো জীবনের লেসন প্ল্যান আমরা জেনে নেই। আসলে আমরা কথা বলতে পছন্দ করি। এটা ভালো দিক কিন্তু এমন কোনো কথা কাউকে বলা উচিৎ নয় যে কথার জন্য কারও সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আমার এক পরিচিতা, নাম তিতির (ছদ্ম নাম)। ভীষণ ভদ্র–শান্ত এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটা মেয়ে। বিয়ে হয়েছে প্রায় ১০ বছর। ওদের এখনো কোনো বাচ্চা হয়নি। এ নিয়ে পারসোনালি তিতির আমার সঙ্গে প্রায়ই দুঃখপ্রকাশ করে। কে কি বলে, কার কথায় ওর কষ্ট লাগে, এসব আমাকে বলে। কিন্তু ওকে আমি কোনো দিন স্যোশাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে কিছু লিখতে দেখিনি। অথচ ইদানিং খেয়াল করছি তিতির স্যোশাল মিডিয়ায় খুব হতাশাজনক স্ট্যাটাস দেয়। সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় কারও দেওয়া দুঃখ থেকে মেয়েটা এসব লিখছে।
একজন মানুষের বাচ্চা না হওয়াটা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু তাকে আঘাত দিয়ে কথা বলাটা অপরাধ। পৃথিবীতে অনেক গুণীজন ছিলেন এবং আছেন যারা বিয়ে করেননি, কোনো প্রজন্মও নেই, তবু তাদের জীবন ছিল ভীষণ বর্ণিল। বিয়ে মানেই কি জীবনের পূর্ণতা? তেমনি সন্তান থাকা মানেই কি জীবনের সবটা পাওয়া? আসলে কি সে যে মানুষের পূর্ণতা তা বলা মুশকিল। তাই যদি হতো তাহলে অসংখ্য মা–বাবাকে সন্তান থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হতো না।
আমরা না বুঝে অনেককে বলে ফেলি, কিরে আগের চাকরিটাই করছিস? তোর মতো মেধাবীর জন্য এটা কোনো চাকরি হলো? তোর উচিত ছিলো বিসিএস দিয়ে সরকারি বড় কোনো চাকরি করা। এমনকি কে কেমন লাইফ পার্টনার বেছে নেবে, সেটাও আমরা ঠিক করি। কে কার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, সেটা তো সেই ভালো জানবে। আমি–আপনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো হরিদাশ পাল হে?
দুজন পরিণত মানুষ যদি ভালো থাকার জন্য, সুখে থাকার জন্য নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয়—নিক না। তাকে চামড়া সেলাইয়ের মতো এফোঁড় ওফোঁড় করে তাতে লবণ মাখানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
কারও ঘরে চাল আছে কি না, ডাল আছে কি না, সে ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে কি না, কারও কোনো অসুখ করল কি না—আমরা এসব তো আগ বাড়িয়ে খোঁজ নিতে যাই না। তাহলে তাদের যাপিত জীবন নিয়ে কেন কাটাছেঁড়া করতে যাব?
আমার বড্ড হাসি পায় এসব অর্থহীন–যুক্তিহীন কথা শুনলে। অন্যের জীবনের পরিকল্পনা কি অনায়াসে আমরা করে ফেলি। কার কিসে ভালো, সেটা তো সেই ভালো জানে। তবু আমরা কী অকপটে মানুষকে দুঃখ দিয়ে ফেলি।
আপনার যা আছে, তা হয়তো অন্যদের নেই। সেই না থাকা মানুষটাকে যদি বারংবার আপনার প্রাপ্তির গল্প বলতে থাকেন, তাহলে সেটা ছোট মনের পরিচয়, অজ্ঞতার পরিচয়।
কিছু বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সংযত হয়ে কথা বলা উচিত। আপনি রোজ পোলাও–কোরমা খান আর আপনার প্রতিবেশি ডাল–ভাতেরই জোগাড় করতে হিমশিম খায়। কিন্তু আপনি যদি প্রতিবেশীর নাকের কাছে গিয়ে ঘিয়ে ডোবানো হাত বাড়িয়ে বলেন, দেখুন ঘিটা কি ভালো ছিলো, তাহলে কি তার ভালো লাগবে? কাজেই এমন বিলাসিতা দেখাবেন না, অন্যদের সামনে যেখানে নিজের আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের অনেক সস্তা বানিয়ে ফেলেছে। আমরা কি খাই, কোথায় ঘুমাই, কেমনে ঘুমাই, আবার ঘুম থেকে উঠে কি করি, এহেনু বিষয় নেই যা শেয়ার করি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এটাও যার যার রুচির ব্যাপার, যে বা যারা এটা করছে, সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে কি দেখাবে, কতটুকু দেখাবে, এটা তার নিজের রুচি, আমার–আপনার কি?
অনেক কিছুই আমাদের ভালো লাগে না। কিন্তু সামনে গিয়ে বলতেও পারি না এটা আপনি করবেন না। সেই অনধিকার চর্চা আমরা করতে পারি না। তবে হ্যাঁ, যা কিছু আমাদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা নিয়ে কথা বলার অধিকার নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আমাদের আছে, তবে তা নিয়ম–নীতির বাইরে গিয়ে নয়।
দিনশেষে মানুষ তার নিজের মতো করে ভালো থাকুক। আনন্দে থাকুক। একটাই জীবন, তা–ও ভীষণ ছোট। সেই ছোট্ট জীবনটাকে অন্যের মতাদর্শে যাপন না করে নিজের মতো উপভোগ করুন।
রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক