ধানের দেশে, প্রাণের দেশে-২

ছবি: লেখক

বিভিন্ন লোকের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, আমাদের হাওরে শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ জমিতে ব্রি- ২৮–এর চাষ হয়েছে। আর মূলত এ জাতের ধানেরই ক্ষতিটা হয়েছে। অন্য জাতের ধানের কোনো সমস্যা হয়নি। অন্যান্য ধানের অসাধারণ ফলন হয়েছে। ব্রি–২৮–এর ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে আমি মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ব্রি–২৮–এর ক্ষতির কারণ হলো ব্লাস্ট (একধরনের ছত্রাকজনিত রোগ)। এ ছাড়া অধিক ইউরিয়া সার ব্যবহার করা ও সময়মতো ওষুধ না দেওয়ার কারণে এমনটা হতে পারে বলে তিনি জানান।

সর্বোপরি এ জাতের ধান চাষ না করাই উচিত বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এ জাতের ধানের রোগ প্রতিরোধশক্তি কমে গেছে। তাই তিনি এ ধানের চাষ না করে ব্রি–৬৭, ৮৪, ৮৮, ৯২ ইত্যাদি জাতের ধান চাষ করার কথা বলেছেন। এ ছাড়া আমি মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. দুলা মিঞার সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনিও ব্লাস্ট রোগের কথা বলেছেন এবং ব্রি–২৮–এর চাষ পরিহার করে ব্রি–৮৮, ৮৯ ইত্যাদি জাতের ধান চাষ করার কথা বলেছেন।

ছবি: লেখক

একটা কথা বলে রাখা দরকার। আমাদের এলাকার কৃষকেরা অনেকেই ধান চাষের বাইরে অন্যান্য ফসলের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছেন। পাট চাষ আমাদের ছোটবেলায় যেমনটা দেখেছি, সে তুলনায় অনেকটা কমলেও অনেকেই এখনো পাট চাষ করেন। এ ছাড়া অনেককে তাঁদের জমিতে মরিচ চাষ করতে দেখেছি। আমরা হাওরে বাউশা গ্রামের খোকা মিয়ার সঙ্গে তাঁর মরিচখেতে কথা বলেছি। তিনি আমাদের জানান, তাঁর ৩ শতাংশ জমিতে মরিচ চাষ করে ১৩ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করেছেন। ২ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন ও আলু চাষ করায় তাঁর আর এগুলো বাজার থেকে কিনতে হয়নি।

২০ শতাংশ জমিতে ক্ষীরা চাষ করে ২০ হাজার টাকার ক্ষীরা বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া ৬ শতাংশ জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করে আয় করেছেন ১০ হাজার টাকা। একই গ্রামের নয়ন মিয়াকে দেখলাম তাঁর ছেলেকে নিয়ে জমি থেকে মরিচ সংগ্রহ করছেন। তিনি ৯ শতাংশ জমিতে মরিচ চাষ করে কাঁচামরিচ বিক্রি করে পেয়েছেন ৫ হাজার টাকা। আশা করছেন, শুকনা মরিচ বিক্রি করে পাবেন আরও ২০ হাজার টাকা। বাউশা গ্রামেরই আরেক কৃষক বদরুল মিয়া ৫ শতাংশ জমিতে মরিচ চাষ করে আয় করেছেন ১৫ হাজার টাকা।

অবশ্য এ ধরনের ফসলের জন্য খরচ যেমন আছে, শ্রমও দিতে হয় প্রচুর। যাহোক, আমরা যখন বদরুল মিয়ার সঙ্গে কথা বললাম, তখন দেখলাম, তাঁর অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে বাঁধন বাবার জন্য ভাত নিয়ে এসেছে। বদরুল মিয়া ভাত খেয়ে বাঁধনের জন্য কিছু ভাত রেখে দিলে বাঁধন নদীর পাড়ে বসে সেগুলো খায়। দৃশ্যটা দেখে আমার ছোট্টবেলার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। আমিও এভাবে আমাদের বাড়ির মানুষের জন্য ভাত নিয়ে যেতাম এবং তাদের সঙ্গে নদীর পাড়ে বসে খুব মজা করে খেতাম। খাওয়ার পর নদীর পানি খেতাম। কী অসাধারণ ছিল দিনগুলো!

ছবি: লেখক

বদরুল মিয়ার খেতের পাশে নদীর পারে কয়েকটি গাছ আছে। দেখলাম, গাছগুলোয় অনেক পাখি এসে আস্তানা গেড়েছে। বিভিন্ন রকম পাখির কিচিরমিচির শব্দে জায়গাটা একেবারে মুখরিত। জায়গাটা পাখিদের ছোটখাটো একটা প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই নদী ছোট–বড় যা–ই হোক না কেন, আমার কাছে খুব প্রিয়। নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে আমার মনটা একেবারে ভরে যায়। তার ওপর পাখিদের মিনি অভয়ারণ্য, অসাধারণ আর মনভোলানো একটা দৃশ্যই বটে।

আরও একটা বিষয় বলা দরকার। সেটা হলো আমাদের এলাকার মানুষের গবাদিপশু পালন। এখন শুধু আমাদের এলাকায় নয়, বরং সারা দেশেই লাভজনক হওয়ার কারণে এটা বেশ জনপ্রিয়। আমাদের এলাকার অনেককেই হাওর থেকে গরুর জন্য ঘাস নিয়ে আসতে দেখালাম। হালচাষের জন্য আগের মতো এখন আর গরু লাগে না। ধান কাটা, ধান মাড়াই—সব মেশিনে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশুপালন হচ্ছে ব্যবসায়িক কারণে। ইদানীং এতে সফলতাও আসছে। আমরা হাওরে গিয়ে অনেককেই গরুর জন্য ঘাস নিয়ে আসতে দেখলাম। এক জায়গায় আমাদের সাক্ষাৎ হলো সাদাফ, সাঈম, আলী নূর, তামজিদ ও হুসাইনের সঙ্গে।

তারা কেউ প্রাইমারিতে, কেউ হাইস্কুলে পড়ে। তারা পাঁচজন মিলে ১১টা গরুর জন্য সকাল–বিকেল ঘাস জোগাড় করে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যায়। দেখে খুব ভালো লাগল যে ওরা পড়াশোনার পাশাপাশি মা-বাবাকে পশুপালনে সহায়তা করে। এমন আরও অনেকের সঙ্গেই আমাদের দেখা হয়েছে। সবার নাম মনে নেই। তাদের মধ্যে যাদের নাম মনে আছে, তারা হলো সাকিব, আনোয়ার হোসেন ও তানভীর।

ছবি: লেখক

গ্রামের অনেকেই হাঁস পালন করছেন, অনেকেই মাছ চাষ করছেন, অনেকেই সবজি চাষ করছেন আর অনেকেই ব্যবসা করছেন। কারও জীবন থেমে নেই। সবাই অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। সন্তানদের পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ধান আমাদের প্রধান ফসল। এ ফসলের ওপর আমাদের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল। এ ফসলের কোনোরূপ বিপর্যয় দেখা দিলে আমাদের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা অনেকটাই হুমকির মুখে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের কৃষিকে অবশ্যই নির্বিঘ্ন করতে হবে। এবার ব্রি–২৮–এর যে ক্ষতিটা হয়েছে, তাতে আমাদের অনেক কৃষকই বিপদের মধ্যে পড়েছেন। এরূপ পরিস্থিতি কোনোমতেই কাম্য নয়।

মনে রাখতে হবে, কৃষকেরা ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব, ভালো থাকবে পুরো দেশ। তাই যেসব জাতের ধান চাষ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, সেগুলো সম্পর্কে অতি অবশ্যই তাঁদের আগাম সতর্ক করতে হবে। আর তা করতে হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থেই।

লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা। শেষ

নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারবেন [email protected]