সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়াবহ রূপ
বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বানভাসি মানুষ নিজ ঘরে থাকার নিষ্ফল চেষ্টা করেছিল। ঘরের ভেতর অনেক আগেই পানি ঢুকেছে। কেউ পানি সেচে কমানোর চেষ্টা করেও পারেনি। শুকনো খাবারের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিস উঁচুতে রাখার চেষ্টা করেছিল, যাতে খাবারের সাময়িক সংকট মেটাতে পারে। সবই বিফলে গেল। অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়েই ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অনেকেই।
মধ্যরাতে পানি বেড়ে যাওয়ায় রাতের আঁধারে অনেককে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। এসব বানভাসি মানুষের চেহারায় মলিনতার ছাপ। চারদিক পানিতে থইথই করছে। কেউ কেউ নৌকা ও ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছে। বাসার প্রয়োজনীয় জিনিস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শত চেষ্টায়ও সেগুলো রক্ষা করতে পারেনি। গবাদিপশুর আরও বেহাল অবস্থা। বন্যার কারণে চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। সব সময় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে এসব বানভাসি মানুষকে দিন পার করতে হচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষ এভাবেই সীমাহীন দুর্ভোগে দিন পার করছে। কেউ কেউ প্লাবিত এলাকা থেকে উদ্ধার পেতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা পাঠাচ্ছে।
বিকেলে যেসব এলাকায় হাঁটু বা কোমরসমান পানি ছিল, রাতের মধ্যে বেড়ে তা গলাসমান হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে ঘরের চালায় আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক উপজেলা শহর বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক পানিতে টইটম্বুর হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামের পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। বিভিন্ন উপজেলায় রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় উপদ্রুত এলাকার মানুষ যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছে না।
পানি যত বাড়ছে, সংকটও তত বাড়ছে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বানভাসি মানুষকে। দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। চলতি মৌসুমে গত মে মাসে প্রথমবারের মতো সিলেটে বন্যা হয়। প্রথম দফা বন্যার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও বন্যা। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে আরও আতঙ্ক। অন্যদিকে, সুনামগঞ্জে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বন্যা হচ্ছে।
প্রথম দফার বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওরের অনেক জায়গাজুড়ে বোরো ধান তলিয়ে যায়। এ কারণে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বিতীয় দফা বন্যায় মৎস্যজীবীদের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। বন্যার পানিতে পুকুর, নদী, খাল-বিল একাকার হয়ে গিয়েছে। যার ফলে, চাষ করা মাছ উৎসস্থল থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
বন্যা হলেই পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বন্যার পানিতে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা একাকার হয়ে রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। এ কারণের আমাশয়, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও জন্ডিসের মতো রোগবালাই দেখা দেয়। ঠান্ডাজনিত এবং মশা-মাছির উপদ্রবে ডেঙ্গু জ্বর বেড়ে যায়। একদিকে বন্যা, অন্যদিকে অসুখ-বিসুখ—সব মিলিয়ে বন্যাকবলিত মানুষ দুর্দশায় জীবন পার করছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট জরুরিভাবে সরবরাহ করা প্রয়োজন।
সমাজের প্রান্তিক মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের অনেকের ঘরে চাল নেই। এ কারণে অনাহারে–অর্ধাহারে তারা দিন পার করছে। তবে ইতিমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অনেকেই কূলকিনারা না পেয়ে এদিক-সেদিক ছুটে চলেছে। আবার তাদের অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান নিয়েছে। সীমান্তবর্তী গ্রামের বিচ্ছিন্ন বাড়িতে অনেকে অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে। বন্যায় ঘরবন্দী এসব মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা অতি জরুরি।
উজান থেকে নেমে আসা ঢল, টানা বর্ষণ ও নদীভাঙনের কবলে পড়ে অনেকেই সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বন্যায় শত শত গ্রাম ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেক শহর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ কারণে এসব বানভাসি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকেই নৌকা বা অন্য কোথাও আশ্রয়ে আশা খুঁজছে। সিলেটে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্যার পানি ঢুকছে।
এ কারণে যেকোনো সময় সারা সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে ও দুর্ঘটনা এড়াতে ইতিমধ্যে সিলেটের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে সিলেট বিভাগ কার্যত সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বলা যায়।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বানভাসি মানুষের কষ্ট-দুর্দশা বাড়তেই থাকবে। তবে এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত, ক্ষতিগ্রস্ত বাসাবাড়ির তালিকা প্রণয়ন এবং নগরীকে বন্যামুক্ত রাখতে করণীয় নির্ধারণে একটি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সিলেট সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ, তালিকা প্রণয়ন ও করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। এ কমিটির যৌথ প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মে, ২০২২)।
সিলেট আবহাওয়া অফিস থেকে জানা যায়, জুন মাসজুড়ে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। গত তিন দিনে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ওই বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সব কটি জেলায় ঢুকছে।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস বলছে, আগামী তিন দিন উজানে ভারতীয় অংশে ও বাংলাদেশ অংশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে (প্রথম আলো, ১৬ জুন, ২০২২)। তাই সে হিসাবে ত্রাণ ও আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখা জরুরি। তা না হলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে, মানুষের দুর্দশা বাড়বে।
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংকার