সম্ভাবনার উপকূল
নোনা জল, ঝড়-ঝাপটা, জোয়ার-ভাটা। শব্দগুলো সামনে এলেই চোখে ভাসে উপকূল, ৭১০ কিলোমিটারের সমুদ্রতীরের জনপদ। কিন্তু সংকটের বাইরে উপকূলের সম্ভাবনার কথা আমরা কজনেই বা জানি, বা মনে রাখি। সুন্দরবন, ইলিশ, কক্সবাজার, আর সমুদ্রবন্দর—এ উপকূলের বৃহৎ সম্ভাবনা। সুন্দরবনকে শুধু উপকূল নয়, বাংলাদেশের ফুসফুস বলতে পারি। একদম মায়ের মতো বাংলাদেশকে আগলে রেখেছে এ সুন্দরবন। যে বাঘ নিয়ে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের গর্ব, সে বাঘের রাজধানীই তো এ সুন্দরবন। সুন্দরবন দর্শনে প্রতিনিয়ত পর্যটকেরা ছুটে যান। বাংলাদেশের বৃহৎ এ বনাঞ্চল যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার।
মিঠাপানির সুস্বাদু ইলিশ মিলছে মেঘনাসহ অন্য নদীগুলোতে। যার বিস্তীর্ণ জনপদ উপকূল। সাগর মোহনায় ইলিশ মিলছে, বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। এ তথ্য দিচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। গেল বছরের শেষ দিকে তারা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ভোলার সীমানাঘেঁষা মেঘনা নদী থেকে ইলিশের উৎপাদন চোখে পড়ার মতো। ইলিশকে ঘিরে এ জনপদ রেখায় কর্মসংস্থান লাখ লাখ মানুষের। বরিশালের তেঁতুলিয়া নদীতেও ইলিশের প্রাচুর্য রয়েছে। এ দুই নদীতে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এ সময় ইলিশ ডিম পাড়তে এ মিঠাপানির নদীতে ছুটে আসে।
একমাত্র বাংলাদেশেই আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। সৈকতের বালুময় পথ আর সাগরতীরের অপূর্ব সৌন্দর্য, ঢেউয়ের মিতালিতে হারায় ভ্রমণপিপাসুরা। এ পর্যটন কেন্দ্রটিকে ঘিরে বৃহৎ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে উপকূলে। পর্যটন রিসোর্ট, নামীদামি হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে এ সৈকতকে ঘিরে।
শুধু কক্সবাজার সৈকতই নয়। সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের বৃহৎ পর্যটন স্পট। এ ছাড়া চর কুকরিমুকরি, গুলিয়াখালি সৈকতসহ উপকূলের আনাচে–কানাচে দেখা মিলছে অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্রের। যেগুলো একদম প্রাকৃতিক এবং নদীমাতৃক।
উপকূলে অবস্থিত তিনটি সমুদ্রবন্দর, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির মানদণ্ডকে রেখেছে পরম উষ্ণতায়। ব্লু ইকোনমির কথা আমরা অনেকেই শুনি। সমুদ্র ও নদীনির্ভর অর্থনীতিই ব্লু ইকোনমি। বাংলাদেশে এ ব্লু ইকোনমির ডানা উড়েছে উপকূলে। এখানে সমুদ্র ও নদীর বিশাল জলরাশিকে ঘিরে অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ লক্ষণীয়। বন্দরগুলোতে টন টন ওজনের মালামাল নিয়ে উপকূলের জলরাশি ছুঁয়ে পাড়ি দেয় জাহাজ। সুতরাং বলা চলে, অর্থনীতির বিশাল এক ভান্ডার এ উপকূল।
অন্যদিকে দেখা যায়, নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা দ্বীপ চরে অর্থনৈতিক পাখার আরেক ডানা। ফসল উৎপাদন তো আছেই। মহিষ চারণের বিশাল ক্ষেত্র এ চরাঞ্চল। একটি উদাহরণ লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের দ্বীপ চর শামছুদ্দিন ও রামগতির দ্বীপ চর গজারিয়া। এ দুটি দ্বীপে শত শত মহিষের চারণভূমি। যেখান থেকে মহিষাদধি দেশের মানুষের প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের চাহিদা মেটায়।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আরেকটি সম্ভাবনা সয়াবিন চাষ। একমাত্র উপকূলীয় জনপদেই সয়াবিন চাষ করে কয়েক গুণ বেশি সয়াবিন উৎপাদন করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি নতুন জাতের সয়াবিন উপকূলীয় অঞ্চলে চাষ করে হেক্টরে প্রায় ৩ টন উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য মো. গিয়াস উদ্দিন মিয়া।
কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়ও আছে এখানে। বিশাল এ অর্থনীতির ভান্ডারকে আমরা কতটুকু আগলে রাখি বা এর যত্ন নিই?
৭১০ কিলোমিটারের জনপদে দুর্যোগ–দুর্বিপাকে মানুষের জীবনমান ব্যাপক হুমকিতে থাকে। বারবার বাঁধ ভেঙে কৃষকের ফলন নষ্ট হয়। বেড়িবাঁধ না থাকায় তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ফসল। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ উপকূলের বেশ কিছু জনপদে প্রতিবছর বাঁধের অভাবে সম্ভাবনার কৃষি ধ্বংস হচ্ছে। অন্যদিকে আছে নদীভাঙনের আতঙ্ক। নদীভাঙনের ফলে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয় উপকূলের মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয়ণকেন্দ্র না থাকায় এখনো ঘূর্ণিঝড় এলে উপকূলের মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
সবশেষ কথা হলো, উপকূলের এই বৃহৎ সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন উপকূলের যত্ন নেওয়া। মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সুযোগ–সুবিধাসংবলিত আশ্রয়ণকেন্দ্র স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিকরণ, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা উন্নত করা গেলে এ উপকূলে আর ঝুঁকি থাকবে না। পুরো উপকূলটাই হয়ে উঠবে বাংলাদেশের স্বপ্ন ও স্বর্গরাজ্য।