যদি একদৌড়ে পদ্মা সেতু পার হতে পারতাম!
সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘একদৌড়ে যদি পার হতে পারতাম!’ একই অনুভূতি আমারও। বছরে একবারের জন্য হলেও ফরিদপুরে যেতাম। নানার কাছে থাকা হতো, বেশ ভালো সময় কাটত। তবে ফরিদপুর যাওয়া কিংবা আসা খুবই কষ্টের ছিল আমার জন্য; আমার কারণে সহযাত্রী হিসেবে আমার মা–বাবারও।
বাড়ি থেকে খুব সকালে বের হতে হতো। ঢাকায় ঢোকা, মানে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পৌঁছাতেই বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা বেজে যেত। সেখান থেকে গ্রেট বিক্রমপুর পরিবহন কিংবা ইলিশ পরিবহনে চড়ে মাওয়া ঘাট। ঘাটের ভোগান্তিটা বেশি হতো ঈদের আগে কিংবা পরে, জ্যামের কারণে। অনেক দূরে নামিয়ে দিত পরিবহনগুলো।
ব্যাগ–ব্যাগেজসহ কিলোমিটার দুয়েক হেঁটে গিয়েছিলাম একবার। আধমরা আমার জন্য যেটা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। লঞ্চ, ট্রলার কিংবা ফেরি—এসবে করে নদী পারাপার। এখানে সময়গুলো অন্য রকম কাটত। ঝালমুড়ি, ছোলাবুট মাখা, দই, এক টাকা গ্লাস পানি—এসব খুব আরাম করে অনেকজন মিলেমিশে খাওয়া, গল্প করা। ঘাট থেকে কিনে আনা গরম পাউরুটি, সঙ্গে কলা, কয়েকজন মিলেমিশে খাওয়া—এসব এখন অতীতের খাতায়। এখন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গেলে সুন্দর অতীত বলেই মনে হবে।
যা বলছিলাম, আমার যাতায়াত ভোগান্তির হতো। বমি করার ভয়ানক সমস্যা ছিল।
আজকাল সেটা মোশন সিকনেসঘটিত বলে মনে হয়। কিন্তু তখন আমি ভাবতাম গাড়ির উৎকট গন্ধ, যেটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। বমি এসে যেত। বমি তো হতোই, শেষ দিকে পেটের ভেতর খাবার না থাকলে সবুজ রঙের কিছু বেরিয়ে আসত। তবু বমি হতো, আধমরা হয়ে পরতাম। বারবার গাড়ি পরিবর্তন, এদিকে বমি করে নাজেহাল অবস্থা। এর জন্য মা-বাবার কষ্টও বেশ হতো। বাসে বমি করলে অন্য যাত্রীরা কেমন বাঁকা নজরে তাকান। এসব কারণে মা-বাবা বছরে কয়েকবার ফরিদপুর গেলেও আমার যাওয়া হতো একবার কিংবা দুবার। কথা একটাই, ‘তুমি কাহিল হয়ে যাও। রাস্তায় কতবার গাড়ি পাল্টাতে হয়, ব্যাগ–ব্যাগেজ আছে, তার ওপর তুমি বমি করো। এত গাড়ি না পাল্টাতে হলে ভিন্ন কথা ছিল।’ সে জন্য গাড়িতে বসে আল্লাহ আল্লাহ করতাম, আর ভাবতাম, ‘একবার ফরিদপুর পৌঁছাতে পারলেই হয়, আর বাড়ি যাব না।’ আবার ফেরার সময় খুব কাহিল হয়ে গিয়ে ভাবতাম, আল্লাহ, এবার একটু কম কষ্টে যদি বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম! না হলে পরেরবার সঙ্গে আনবে না। কিন্তু খুব কমই সৌভাগ্য হতো তেমন। বমি করা থেকে বাঁচতে বমির বড়ি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা—কী করা হয়নি! কিছুতেই কিছু কাজ হতো না।
যাত্রাবাড়ী থেকে কিছু হকার বাসে উঠত! যারা হজমের বড়ি, দাঁত মাজার হরেক রকম জিনিস, গাছের মূল, পাউডার, লেমন জুস বিক্রি করত। এর মধ্যে হকাররা আমার ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে হজমের বড়ি নিয়ে চিৎকার করত বেশি করে। কারণ, আমাকে বমি করতে দেখত তারা। এগুলো কিনে মুখে গুঁজে দিয়ে রাখতাম, কিছু সময়ের জন্য কাজ করত। আবার যা তা-ই হয়ে যেত।
নরসিংদীর শিবপুর থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, যাত্রাবাড়ী হতে মাওয়া, নদী পার হয়ে কাওরাকান্দি কিংবা কাঁঠালবাড়ি ঘাট, এপারে এসে ভাঙ্গা বিশ্বরোড গোলচত্বর, সেখান থেকে গন্তব্য। আবার ঘাট থেকে নানান অলিগলি পেরিয়ে বিচিত্র কিছু যানবাহনে গন্তব্যে যাওয়া যেত সরাসরি, যাতে পুরো যাত্রাপথে সব মিলিয়ে সাত থেকে নয় ঘণ্টাও লেগে যেত। এই যে এত সময়, ভোগান্তি, কাটা পথ, বারবার গাড়ি পরিবর্তন, এখন সেটা কমে যাবে।
ছোটবেলায় এ নদী পারাপারের সময় ভাবতাম, মাঝখানে এত বড় চর, এ চরের সঙ্গে ছোট ব্রিজ তৈরি করলেই এতটা নদীপথ পাড়ি দিতে হতো না। যেমনটা ধলেশ্বরী নদীতে দেখা যায়। তখন বাবা বলতেন, এই নদীর অনেক ক্ষমতা। বড়রা গল্প করতেন আগেরবার চর কোন দিকে ছিল, নদীর মূল পথটা তারা প্রথমে কোন দিকে দেখেছিলেন? সেসব আঙুল দিয়ে দেখাতেন। চরের ছোট ছোট টিনের ঘর দেখে খুবই ভালো লাগত। আবার এ চর ভেঙে যাওয়ার গল্প শুনে এসব ঘরের বাসিন্দাদের জন্য মন খারাপ হয়ে যেত। তারপর তাঁরা আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘এই যে খাঁ সাহেব, বলো তো, চর যে বেশি দিন টেকে না, নদীতে মিলিয়ে যায়, তখন ব্রিজের কী হবে?’ কৌতূহলী মন ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে শেষে ভুলেই যেতাম। আবার কখনো মাঝপদ্মায় লঞ্চে, ফেরিতে বসে দুই পাড় দেখতে না পেয়ে ভাবতাম, ‘যদি ওপর থেকে দেখতে পেতাম! নদীটা আসলেই কেমন?’ এসবের উত্তর আজ সবাই জানে। খরস্রোতা এই নদীর কথা আমিও জানি। এবার সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক কৌতূহলের উত্তর পাব নিশ্চয়ই।
অর্থনৈতিক বিপ্লব, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। যাতায়াতের ভোগান্তি কমছে—এটাই আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। আরেকটা বিষয়, পদ্মা সেতুর স্প্যানগুলো দেখে দেখে মনে হতো শেষ হয় না কেন? লঞ্চ, ফেরিতে কিংবা ট্রলারে করে যাতায়াতে বারকয়েক সেতুর খুব কাছ থেকে দেখেছি। ভাবনায় ছিল শুধু, কবে চড়ব সেতুতে? নদী পারাপারের সময় হরেক রঙের মানুষের দেখা মিলত। কেউ নিজেদের স্বপ্ন পূরণের কথা বলত, আবার কেউ কেউ তাতে ফোড়নও কাটত। কেউ কেউ একটি–দুটি করে স্প্যান বসানোয় রাজনৈতিক গন্ধ খুঁজে পেতেন। সেসব গল্পে তো আর কিছু বলা যায় না, তবে শুনে কিছুটা মুচকি হাসতাম।
আমি এখন আর বাসযাত্রায় বমি করি না। নরসিংদী থেকে সুদূর কুষ্টিয়ায় বাসে ভ্রমণ করি একা একাই। ফরিদপুরেও একাই যাই। মা-বাবা সঙ্গে গেলে বরং তাঁদের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, যেটা তাঁরা আমার জন্য করতেন। এই সেই স্বপ্ন! পদ্মা সেতু, তাতে কবে চড়ব! একদৌড়ে না হোক, বাসে চড়ে নদীর বুকচিরে গড়ে ওঠা পিচঢালা পথ দিয়ে যাব। ভাবতেই আনন্দ কাজ করছে। উদ্বোধন করার কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো স্বপ্নের সেতু পাড়ি দেওয়ার সৌভাগ্য হতে পারে। সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে খুব বড় একটা পরিবর্তনের সাক্ষী হতে যাচ্ছি। বদলে যাওয়া এক যাত্রাপথ, যাতায়াতব্যবস্থা—সব মিলিয়ে শিহরিত নতুনের জন্য।
লেখক: মো. মঈনুল হক খান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।