মানুষ খাবে কী?

অতীতে দেশের বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেলে মূল্যবৃদ্ধি পেতে দেখেছি আমরা। ঈদ, রোজা কিংবা কোনো উৎসবে যখন যে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়, তখনই সেসব পণ্যেও দাম কয়েক গুণ হয়ে যায়। যেসব পণ্য দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলোর দামও নানা অজুহাতে হঠাৎ বেড়ে যেতে দেখেছি আমরা। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। আগে দু–একটি পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলেও এবার প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম একসঙ্গে বাড়ছে।

এ মাসের প্রথম সপ্তাহে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। ভরা মৌসুমে চালের মূল্য বৃদ্ধি দেখে বিস্মিত বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘আমার লাইফে (জীবনে) এই ভরা মৌসুমে এভাবে মিনিকেট চালের দাম বাড়তে দেখিনি। দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বড় শিল্পপতিরা হয়তো ধান ও চাল মজুত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো দরকার।’

আবদুর রশিদের বক্তব্যে পরিষ্কার, একটি গোষ্ঠী মজুত করছে ধান ও চাল। নতুবা এমন ভরা মৌসুমে ধান ও চালের দাম অনেক কম থাকার কথা। ভাত আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। এখন এটার দামও যদি নাগালের বাইরে চলে যায়, তবে মানুষ খাবে কী? সারা দিন পরিশ্রম করার পর ভাত খেয়ে আমরা ক্যালরি পূরণ করি।

তাই এটার দাম যাতে সবার সামর্থ্যের মধ্যে থাকে, সেই দিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালের ঊর্ধ্বগতি রোধে বাজার দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

কেউ অবৈধভাবে চাল মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তাঁর নির্দেশের পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে অভিযানে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তবে তাদের আসার খবরে পালিয়ে যান চাল ব্যবসায়ীরা। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (মেট্রো) ফাহমিনা আক্তারের বারবার অনুরোধেও তাঁরা দোকানে ফেরেননি। ব্যবসায়ীদের পালিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে তারা মূল্যবৃদ্ধির সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।

অভিযানের পরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ফাহমিনা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, মূল্যতালিকায় অসংগতি পাওয়ায় এস এম রাইস এজেন্সি এবং আনোয়ার ট্রেডার্স নামে দুই দোকানকে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাঁরা আমাদের জানিয়েছেন, চাল যে দামে কেনেন সেখান থেকে দোকান পর্যন্ত আসতে প্রতি কেজিতে তাঁদের আরও দুই টাকা খরচ পড়ে। পরে ১ টাকা (প্রতি কেজি) লাভে সেই চাল বিক্রি করেন তাঁরা। যদিও মূল্যতালিকায় প্রতি কেজিতে ১০-১২ টাকা বেশি দেখা গেছে। এ জন্য দুই চাল ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়।

২.

সাধারণ মানুষ ভাতের বিকল্প হিসেবে যে আটার রুটি খাবে, সেই উপায়ও নেই। সিলেট শহরের কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখলাম, বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। আর বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক মাসের মধ্যে আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা। গত বছর এ সময়ে বাজার থেকে খোলা আটা ৩০ থেকে ৩২ টাকা ও প্যাকেটজাত আটা ৩২ থেকে ৩৫ টাকায় কিনতে পেরেছেন মানুষ। এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আটার দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।

কিন্তু মানুষের আয় কি বেড়েছে? শুধু চাল কিংবা আটা নয়, বাজারে সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। গত সপ্তাহে ডিমের দামও বেড়েছে। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৯৮ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়। বাজারে ১০০ টাকার নিচে বড় দানার ডালই পাওয়া যাচ্ছে না। ছোট দানার ডালের দাম আরও বেশি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে আটা, ময়দা, তেল, ডাল, রসুন, ডিমের দাম ২৯ থেকে ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

৩.

নিত্যপণ্যের দাম ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। উল্টো করোনার কারণে অনেকের বেতন কমেছে। করোনার কারণে এমনিতেই মানুষের হাতে টাকা নেই। যা সঞ্চয় ছিল তা করোনার সময় শেষ করেছেন অনেকে। অনেকে খাবারে পরিবর্তন করেছেন। সিলেট শহরে মেসে থাকা আমরা এক বন্ধু জানাল, খরচ কমাতে তারা খাবারে পরিবর্তন এনেছে। সপ্তাহে তিন দিন আলুভর্তা ও ডাল এবং ডিম দিয়ে পার করেন। পত্রিকার খবরে দেখলাম দিনাজপুরের এক শিক্ষক বলছেন, যেখানে কিনতাম এক কেজি চাল, সেখানে কিনছি আধা কেজি। কী করার আছে? উপায় নেই। না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বা আপার পোভার্টি রেট বেড়ে এখন ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এমন কঠিন দিন পার করলেও দাম কমাতে সরকার কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কয়েকটি অভিযান ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। উল্টো সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, মানুষ চাইলে এখন তিন বেলা মাংস খেতে পারে।

কয়েক মাস আগে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, এখন রিকশাওয়ালাও মোটা চাল খায় না, মোটা চাল এখন গরুকে খাওয়ানো হয়।
মন্ত্রীদের এমন বক্তব্য জনগণের সঙ্গে উপহাস ছাড়া আর কিছু নন। মন্ত্রীরা নিজে হয়তো তিন বেলা মাংস খান। মোটা চাল হয়তো তাঁদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ দেশের জনগণ মোটা চাল কিনতে পারছেন না। মাংস খাওয়ার কথা অনেকে কল্পনা করতে পারেন না। এখন জনগণ তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেলে পারলেই সন্তুষ্ট।