বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং: দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তবতা

ফাইল ছবি

দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গড়পড়তা কথাবার্তা মাঝেমধ্যে আলোচনায় এলেও এ নিয়ে মূলত ঝড় ওঠে কিউএস র‌্যাঙ্কিং প্রকাশের পরপরই। বরাবরের মতো এবারের পরিসংখ্যানের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। তবে এ আলোচনা-সমালোচনা অবশ্য গুটিকয়েক শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ আর মিডিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির কারও আছে এসব র‌্যাঙ্কিংয়ের খবর পৌঁছায় কি না, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তো এবারের কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটিও নেই।

অন্যদিকে কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ৫০০–এর মধ্য প্রতিবেশী ভারতের ৯টি ও পাকিস্তানের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যা আনুপাতিক হারে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। তবু কেউ র‌্যাঙ্কিংয়ে আসতে পারেনি, উন্নতিও করতে পারেনি। এসব নিয়ে একজন উপাচার্য বলেছেন, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ও র‌্যাঙ্কিংয়ে নেই। আরেক উপাচার্য বলছেন, কে কী র‌্যাঙ্কিং করল, তা দেখি না। শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছেন তিনি। এই উপাচার্যের বক্তব্য ইতিবাচক।

বেশ কয়েক বছর ধরে উচ্চশিক্ষার মান ও বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং নিয়ে শিক্ষাঙ্গনে তোলপাড় শুরু হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। শতবর্ষ পেরিয়েও প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলছে তারা এখন শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিতে চান। কতটা বদলাবে, কতটাই–বা সম্ভব, সেটা সময় ঠিক বলে দেবে। যাহোক, কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তি হচ্ছে আটটি সূচক। সূচকগুলো হলো একাডেমিক খ্যাতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত, চাকরির বাজারে সুনাম, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ও কর্মসংস্থান। এসব সূচকের আলোকে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে যা পাই তাই বলে দিচ্ছে কতটা কঠিন আর প্রতিকূল পথ পাড়ি দিতে হবে।

একাডেমিক খ্যাতি নির্ধারিত হয় মূলত শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে। আর এ দুটোর কী অবস্থা, তা আমরা সবাই জানি। বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১: ২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। অথচ গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে আমাদের সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয়েই এই মানদণ্ড নেই।

শিগগিরই শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি সূচক অর্জন কতটুকু সম্ভব, সেটাই ভাববার ব্যাপার। কারণ, এ দেশে রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি বা টাকার বিনিময় প্রভাবে নিয়োগ যোগ্যতার সর্বনিম্ন শর্তাবলীতে কিংবা শিট মুখস্থ করে উচ্চ সিজিপিএ ধারণকারী শিক্ষার্থীরাই অধিকাংশ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। এমন নিয়োগের ফলে এসব শিক্ষকের একদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে কম, একই সঙ্গে গবেষণা বা উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণেও থাকে আলসেমি। অনেকের গবেষণা উদ্দেশ্য থাকে আবার বেতন স্কেল বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। ফলে আমরা অহরহ দেখতে পাই সেসব গবেষণায় থাকে প্লেগারিজম। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী থাকলেও বাকি অনেক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো জানেই না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী না থাকলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ম্লান হয়। যদি র‍্যাঙ্কিংয়ে না থাকে, না থাকে যদি মানসম্মত শিক্ষা তাহলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আসবেই–বা কীভাবে! আর আন্তর্জাতিক শিক্ষকও নেই। আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের কোনো আগ্রহও নেই এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সৃজনশীল ও উৎপাদনশীলতার অনুপস্থিতির ফলে বের হয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েটরা চাকরির বাজারে আলাদা বিশেষত্ব তৈরি করতে পেরেছে, এমন দৃশ্যও এ দেশে কমই দেখা যায়। এদিকে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০–এ আমরা দেখতে পাই ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা বছরজুড়ে দু-চারটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য কোনো গবেষণা করেনি। আবার গবেষণায় খরচ করেও কোনো প্রকাশনা বের করতে পারেনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সোয়া কোটির বেশি ব্যয় করে হাবিপ্রবির প্রকাশনা ছিল ১টি। নোয়াখালী, যবিপ্রবি এবং ববি দুটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। আর কর্মক্ষেত্রের দিকে নজর দিলে দেখা যায় দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি হচ্ছে না। এমনকি চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও নেই। ৫ বছরের একাডেমিক পড়াশোনার ৫ ভাগও চাকরি পরীক্ষায় কাজে আসে না। শিক্ষার সঙ্গে নেই কর্মক্ষেত্রের মিল। আবার এ দেশে চাকরি বলতে ওই বিসিএস। দেশ–বিদেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মক্ষেত্রগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা চাকরিপ্রার্থীদের পদচারণে লক্ষণীয় নয়।

এই যখন সার্বিক পরিস্থিতি, তখন এসব সূচকে উন্নতি করতে আন্তরিক উদ্যোগ ও সময়ের দরকার আছে। বিদ্যমান সিস্টেমে এটা যে ত্বরান্বিত হবে, তা আশা করাও দুষ্কর। ফলে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে পৌঁছাতে বহুত কাঠখড় পোহাতে হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সবার আগে যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা। তারপর মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও গবেষণায় মনোনিবেশ। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণার তুলনায় মনুমেন্ট নির্মাণে বেশি বরাদ্দ হওয়া কখনোই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। সম্প্রতি আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষার মান নিশ্চিত না করে এত বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কেন গড়তে হবে, তার রহস্য সংশ্লিষ্টরা ভালো জানেন। তবে ১০ হাজার কোটিতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে সেই টাকা গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করলে, সেটা হবে উচ্চশিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন। এতে উচ্চশিক্ষায় ভালো পাঠ্যসূচি, মানসম্মত শিক্ষক, সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে।

সর্বোপরি এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার স্বকীয়তায় বাঁচিয়ে রাখতে সরকার, রাজনীতি ও ইউজিসির সম্মিলিত সদিচ্ছার প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন রাজনীতিমুক্ত জ্ঞানতাপস, গবেষণাপ্রেমী, শিক্ষার্থীবান্ধব এবং নির্লোভী দক্ষ উপাচার্য। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যেকোনো উপায়ে এটা করতে পারলে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে জ্বলজ্বল করবে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। বাংলাদেশের গৌরব হবে মহামান্বিত।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া