বাজেট হোক সাধারণ মানুষের জন্য, যারা চায় দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অন্য সময়ের তুলনায় এখন বেশি। সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দিন দিন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন জাতীয় বাজেটের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো দেশ।
সাধারণত বাজেটের পর স্বাভাবিক নিয়মে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এবারের বাজেটের পর যেন বাজেটের অজুহাত দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে না দেন, তা নিশ্চিত করতে সরকারের এখনই পরিকল্পনা করা দরকার। এবারের বাজেটে যদি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর ভর্তুকি দেওয়া যায়, বিশেষ করে চিনি, পেঁয়াজ-রসুন, বিভিন্ন ধরনের মসলা, চাল-ডাল, তেল প্রভৃতিতে তাহলে অন্তত উচ্চমূল্যে ক্রয় করার হাত থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষা পাবে।
নিম্ন আয়ের মানুষ বিলাসবহুল দ্রব্য চায় না। তারা চায় তিন বেলা পেট ভরে খাওয়ার মতো মাছ-ভাতের নিশ্চয়তা। কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যের দাম যেভাবে ক্রমে বাড়ছে, তাতে এই সামান্য প্রথম চাওয়া পূরণ করতে বাড়ির কর্তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে, বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি রাখা। যদিও এরই মধ্যে সরকার শিক্ষার প্রসারে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। যার ফল আমরা পাচ্ছি। আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ শিক্ষার্থী স্কুলে গমন করছে। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার কারণে এখন আর পিতা-মাতারা বাল্যবিবাহ দিতে আগ্রহী নন। এ সুযোগে বহু মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা যায়, তাহলে এই হার অবশ্যই বাড়বে। এই বাজেটে সে ধরনের কোনো ভর্তুকি রাখার ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে।
করোনা-পরবর্তী সবচেয়ে বেশি জরুরি শিক্ষার উপকরণে (কলম, খাতা, কাগজ প্রভৃতি) ভর্তুকি দেওয়া, যাতে সহজে কৃষক ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা এগুলো কিনতে পারে। করোনাকালে যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, তারা যেন টাকার অভাবে আবার বিদ্যালয়ে ফিরতে হিমশিম না খায়, তার দিকে নজর দেওয়া। করোনাকালে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা পড়ালেখা করত। ওই বিদ্যালয়গুলো যেন এখন আবার চালু করা যায়, তার জন্য বাজেটে সরকারের কাছে অনুদান চাই। গবেষণা সব সময় অবহেলিত খাত। বাংলাদেশের বর্তমান টেকসই উন্নয়নকে ধরে রাখতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তাই বাজেটে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ গবেষকদের জন্য পর্যাপ্ত অনুদান নিশ্চিত করার দাবি জানাই।
নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা স্বল্প। তারা চায়, তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলানো ফসলের ন্যায্যমূল্য। আগামী বছর যেন আবার ফসল ফলাতে পারে, এমন পুঁজির সংস্থান দরকার। বলে রাখা ভালো, আমাদের দেশে বিভিন্ন শিল্পকারখানা স্থাপিত হলেও কৃষিকাজকে এখনো অবহেলা করার সুযোগ আসেনি। তাই এ বাজেটে কৃষকের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ থাক, এমনটি সবার প্রত্যাশা। আর কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য পান, এ জন্য সরকারি উদ্যোগে বেশি করে ফসল সংগ্রহের বরাদ্দ রাখা হোক। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে খাদ্যসংকট শুরু হতে যাচ্ছে, তার প্রভাব যাতে বাংলাদেশে না পড়ে, তার জন্যও পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত করা প্রয়োজন। তাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বেশি করে কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ।
পাশাপাশি সীমিত সুদে কৃষককে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা যেন থাকে। মধ্যযুগে ভারতের সুলতানি শাসক শেরশাহ যদি কৃষকদের কল্যাণে অনেক পদক্ষেপ নিতে পারেন, বিনা সুদে ঋণ, ফসল নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন, তাহলে আধুনিক যুগে আমরা কেন তা পারব না। এই বাজেটে যেন সার ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ওষুধের (যেগুলো আমদানি করতে হয়) জন্য ভর্তুকি রাখা হয়। আর নিজেরা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারলে বৈশ্বিক কোনো সংকট আমাদের চিন্তিত করবে না।
পেঁয়াজ ও তেল নিয়ে যেসব রাজনীতি গত কয়েক বছর হয়েছে, তার সমাধানে এই বছর বাজেটে বরাদ্দ রাখা দরকার। অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে চাষিদের পেঁয়াজ ও শর্ষে চাষে উৎসাহিত করলে আমাদের বিশ্বাস, তেল ও পেঁয়াজে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। একসময় বাংলার ঘরে ঘরে রান্নায় শর্ষের তেল ব্যবহৃত হতো। বাংলার সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দরকার। নিজেরা পেঁয়াজ ও শর্ষে উৎপাদন করলে ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজ আমদানিতে যে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে, তা রক্ষা পাবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মাছের চাষ হয়। সাধারণত এসব খামারে সাদা সোনা চিংড়ি চাষ হয়। কিন্তু ইদানীং বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এসব অঞ্চলের কৃষকেরা পরপর কয়েক বছর লাভের মুখ দেখতে পারেননি।
পাশাপাশি অবৈধ মুনাফাখোর চিংড়ি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নেওয়ার কারণে তাঁরা এখন পথে বসেছেন। তাই চিংড়িশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে খামারিদের জন্য সরকারি উদ্যোগে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। পাশাপাশি চিংড়ির পোনা, মাছের খাবারসহ চাষাবাদের বিভিন্ন উপকরণ বিনা মূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবেই পুনরায় এই শিল্প থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। তা না হলে এই শিল্পের ধ্বংস সময়ের ব্যাপারমাত্র। উল্লেখ্য, বর্তমানে পোশাকশিল্পের পর চিংড়ি রপ্তানি করে এককভাবে কোনো খাত থেকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।
বাজেট হোক সাধারণ মানুষের জন্য, যারা সত্যিকার অর্থে বাজেট কী সেটা বোঝে না, যারা চায় দুবেলা দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা। আর দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরার বাজেট হোক, যাতে মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের মাসিক বাজেট ফেল না করে। মধ্যবিত্ত গৃহিণীর হিসাব বাজারে গেলে যেন ওলটপালট না হয়ে যায়। বাঙালি সাধারণত উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনে অভ্যস্ত নয়। চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মাছ-ভাতে তারা খুশি। বাঙালি সর্বদা কুঁড়েঘরে মোটা কাপড়, মোটা ভাত আর এক টুকরা মাছে খুশি থেকেছে।
সরকারের উচিত মাথাপিছু আয় না দেখে, আয়বৈষম্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। যাতে দেশের নিম্ন আয়ের লোকজন সুন্দর জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে। বাজেটে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর জোর দিতে হবে। তাদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিকে নজর দিতে হবে। সব মিলিয়ে আগামীর বাজেট হোক জনকল্যাণমুখী, এটাই সবার প্রত্যাশা।
* লেখক: রবিন আহমেদ রাজিন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা