বাজারে বিপর্যয় ও আমাদের দায়
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাজার ও জনজীবনের মধ্যে সম্পর্কটি কেমন, কয়েকটি প্রশ্নের মাধ্যমে তা মূল্যায়নের চেষ্টা করা যেতে পারে: দেশের বাজারে কোনো সেবা বা পণ্যের দাম কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে, কে তা নির্ধারণ করছে? দাম নির্ধারণের পেছনে যুক্তি বা ভিত্তিটি কী? এই দাম কত দিন ধরে অপরিবর্তিত থাকার কথা আর বাস্তবে তা কত দিন থাকছে? একই ধরন ও মানের সেবা বা পণ্যের দাম কি জোগানদাতাদের সবার ক্ষেত্রে অভিন্ন? অভিন্ন না হলে ব্যত্যয় কতটা? এসব সেবা ও পণ্যের গুণগত মান কতটা? এই মান কি সব ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা হচ্ছে? মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? বাজারে যেসব পণ্য বা সেবা রয়েছে, তা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর সবার কাছেই কি সহজলভ্য? অন্তত মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য দরকারি পণ্য ও সেবা ক্রয়ে সাধারণ মানুষের সক্ষমতা কতটুকু?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাদি এবং চারপাশের সাধারণ মানুষের স্বগতোক্তি থেকে যতটা অনুমান বা অনুভব করা যায়, তাতে এটি স্পষ্ট যে এসব প্রশ্নের কোনোটিরই খুব ইতিবাচক জবাব আসলে নেই। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে পরের আলোচনায় আসা যাক।
কোমল পানীয়ের ২৫০ মিলি বোতলের দাম ব্র্যান্ড বা প্রস্তুতকারক কোম্পানিভেদে ১৫ কিংবা ২০ টাকা। অনেক ফাস্ট ফুড শপ বা রেস্তোরাঁয় এই ১৫ বা ২০ টাকার পানীয় গ্লাসে ঢেলে দাম রাখা হচ্ছে ৬০ বা ৭০ টাকা কিংবা আরও বেশি। দামের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা মালিকের দোহাই দিচ্ছে। চায়ের ক্ষেত্রেও এক চিত্র। একটি কোম্পানির গ্রিন–টির ৪০টি টি-ব্যাগের একটি প্যাক ১৭০ টাকা। সেই হিসাবে ১টি টি-ব্যাগের দাম হয় ৪ টাকা ২৫ পয়সা। এই একই কোম্পানির একটি টি-ব্যাগ দেওয়া এক কাপ চায়ের দাম ঢাকা শহরে ২০ থেকে ৮০ টাকা বা এরও বেশি। কফি বা বার্গারসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও এমন অযৌক্তিক মূল্য রয়েছে। ভাত বা পোলাওয়ের চাল, ডাল ইত্যাদি পণ্য নাম বা জাতে এক হলেও কোম্পানিভেদে অথবা খোলা কিংবা প্যাকেটজাত হলে এসবের দামে কেজিপ্রতি প্রায় ১০ থেকে ৩০ টাকা বা এরও বেশি পার্থক্য রয়েছে।
করোনা অতিমারিকালে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার বেড়েছে। বাজারে ৫০ মিলি স্যানিটাইজারের বোতলের দাম ৫০ থেকে ১৪৫ টাকা কিংবা কিছু ক্ষেত্রে এর থেকেও বেশি। ৫০ থেকে ১৪৫ টাকার মধ্যেই ব্যবধান ৯৫ টাকা! একটি কোম্পানির ২০০ মিলি বোতলের দাম যেখানে ২০০ টাকা (পুরোনো দাম) কিংবা ২২৫ টাকা (নতুন দাম), একই কোম্পানির ৪০ মিলি বোতলের দাম রাখা হচ্ছে ৮০ টাকা। অন্য একটি কোম্পানির ২০০ মিলি বোতলের দাম ২০০ টাকা, ৫০ মিলি বোতলের দাম ৫০ টাকা এবং ১০ মিলি স্প্রের (পেন) দাম ৭০ টাকা! পরিমাণভেদে দামের এই আকাশ-পাতাল ব্যবধান কি স্বাভাবিক? বিশেষ করে ছোট বোতল কিনলে ক্রেতাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে।
কেবল এসবই নয়, পোশাক বা অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও বাজারভেদে এমন নৈরাজ্য রয়েছে। মানের বিচারেও অনেক পণ্যেরই দাম অযৌক্তিক বা দামে গরমিল রয়েছে। আর পণ্যের মানও সব সময় নিশ্চিত করা হচ্ছে না। এগুলো যে সব সময় চোখের আড়ালে ঘটছে, তা নয়; অনেক কিছুই প্রকাশ্যে ঘটছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: অফিসে একদিন কাছের এক দোকান থেকে টক দই আনানোর পর এর মোড়কে দেখা গেল, দইয়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে আরও চার দিন আগে। অফিসের সহকারীকে আবার দোকানে পাঠিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে বলা হলো, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য কেন দিয়েছে। সহকারী ছেলেটি আগেরটি ফেরত দিয়ে আরেকটি দই এনে বলল, বদলে দিয়েছে। এবার দেখা গেল, যেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ লেখা, সেই অংশটুকু ঘষে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
খবরে মাঝেমধ্যে দেখা যায়, নোংরা পরিবেশে এমনকি বস্তির টয়লেটে জুস-চকলেট-বিস্কুটসহ নানা (অ)খাদ্য তৈরি হচ্ছে। কাপড় বা আসবাবপত্রে ব্যবহার্য রং খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘১০০ ভাগ ফলের জুস’ বলে বোতলে বিক্রি হচ্ছে কেবল পানি, রং ও ফ্লেভারসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক। দেশের নামী-দামি কিছু কোম্পানিও এর ব্যতিক্রম নয়। পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক, নিম্নমানের ময়দা, অ্যারারুট পাউডার, কস্টিক সোডা, ইথাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড, চক বা চুনজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘খাঁটি গরুর দুধ’!
দই, মিষ্টি বা ছানা তৈরিতেও একইভাবে ভেজাল দ্রব্য এমনকি টিস্যু পেপার মেশানো হচ্ছে। ফলমূল ও মাছে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন, কার্বাইডসহ ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক। ফার্মের মুরগির লাল ডিমকে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করে ‘হাঁসের সাদা ডিম’ বানানো হচ্ছে। চালে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউরিয়া। শাকসবজিতে বিষাক্ত কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে। গুঁড়া মরিচে ইটের গুঁড়া আর গুঁড়া হলুদে মাটি-কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। হলুদসহ নানা মসলার গুঁড়ায় মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত সিসা। এমনকি গুঁড়া দুধের মতো শিশুখাদ্যেও সিসা–মেলামিনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর পদার্থের অস্তিত্ব মিলছে।
কোনোরকম দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য ব্যবহার না করেই তৈরি হচ্ছে ‘১০০% খাঁটি গাওয়া ঘি’! মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রং, ফ্লেভার, পাম অয়েল বা ডালডা, গরু-মহিষের চর্বি, সুজি, রং ও একজাতীয় আঠা একসঙ্গে চুলায় জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এই ‘খাঁটি ঘি’। সসের নামে রং ও বিষাক্ত অন্যান্য উপকরণ খাওয়ানো হচ্ছে। ট্যাপের অপরিশোধিত পানি বোতলে ভরে বিক্রি চলছে মিনারেল ওয়াটার বলে। নাজিরশাইল বা মিনিকেট বলে চালের কোনো জাত নেই এবং এই নামে কোনো চাল বাজারে বিক্রি করা যাবে না—সরকার এমন নির্দেশনা দিয়েছে কয়েক মাস আগে; এখনো বাজারে এই নামেই চড়া দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। ‘ঘানিভাঙা খাঁটি সরিষার তেল’ বলেও বিক্রি হচ্ছে বিষাক্ত নানা রকম রাসায়নিক মেশানো তেল।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে নামী-দামি হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল বা নিম্নমানের ওষুধ এবং চিকিৎসার অন্যান্য সামগ্রী মিলছে। কিছু ক্ষেত্রে একই ওষুধ ফার্মেসিভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। করোনা মহামারি শুরুর পর দেখা গেছে, ৫ টাকার মাস্ক ৫০, ১০০ এমনকি ২০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে।
সংকট কেবল পণ্যের দাম কিংবা মানে নয়, সহজলভ্যতার ক্ষেত্রেও। চাল-তেল-পেঁয়াজসহ নানা ধরনের পণ্য অবৈধভাবে মজুত করে রেখে বাজারে সরবরাহের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চড়া দামে বিক্রির ঘটনা দেশে নতুন নয়। এসব বুজরুকির খবর সবার জানা থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের এসব কর্মকাণ্ড এখন পর্যন্ত বন্ধ করা যায়নি।
চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ কিংবা পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ—আমাদের দেশে যত ঘন ঘন ও যে হারে এসবের দাম বাড়ে, পৃথিবীর অন্য কোথাও বোধ হয় এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকারি আধিকারিকেরা এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন দেশের বাজারে কোনো পণ্যের অভাব নেই, তখনো বাজারে এগুলো সহজে মিলছে না বলে বাড়তি দামে এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে। এর ব্যাখ্যা কে দেবে আর দায়ই–বা কে নেবে?
এসব বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এমনটি মনে হওয়া বিচিত্র নয় যে ভোক্তা অধিকার আইন তাহলে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে পারছে না; ভোগান্তির পর কেবল মামলা হলেই এ আইন কাজে আসবে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন—জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ভূমিকা কি কেবল মাঝেমধ্যে অভিযান চালানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে? ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অভিযোগ জানালে কেবল বিচ্ছিন্নভাবে ওই সব গুটিকতক ঘটনারই সুরাহা হবে, বাকিদের ক্ষেত্রে নয়? স্বাস্থ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যরাই–বা কী করছে? তাদের কি ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছে? বাজারের অস্থিতিশীলতায় নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ নাগরিকদের মনে এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খায়; তাদের এসব প্রশ্নের সদুত্তর কার কাছে ও কবে মিলবে?
এসব সংকট থেকে শিগগিরই মুক্তি দরকার। মিথ্যাবাদিতা ও আর্থিক দুর্নীতি এসব সংকটের অন্যতম দুটি কারণ। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে এ সংকট থেকে মুক্তি মিলবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছেন অনেক আগেই; কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের নানা স্তরে এবং বেসরকারি খাতে সবার দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার বিকল্প নেই। সরকারের দায়বদ্ধতা তো অবশ্যই রয়েছে, তবে কেবল সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না; ব্যক্তি হিসেবে আমাদের নিজেদের মধ্যেও এ ব্যাপারে সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার বোধ জাগ্রত হওয়া দরকার।
আমরা যে যেখানেই আছি, যে দায়িত্বেই আছি, সেখানে আমার কী ভূমিকা থাকার কথা আর আমি কী করছি—কেবল এইটুকু দিয়েই যদি আমরা সবাই নিজেদের মূল্যায়ন করি, তাহলেও সমাজটা বদলে যাবে, রাষ্ট্র বদলে যাবে; আমরা সবাই একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের পাশাপাশি এর সুবিধাদি ভোগ করতে পারব।
*লেখক: সজীব সরকার, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন