বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ই-লার্নিং
ডিজিটাল প্রযুক্তি হলো সেই প্রযুক্তি, যা ডিজিটাল ডিভাইস, সফটওয়্যার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও শেয়ার করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। উদাহরণ হিসেবে কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, স্মার্টবোর্ড ও বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে উল্লেখ করা যায়।
ই-লার্নিং (ইলেকট্রনিক লার্নিং) হলো শিক্ষার একটি পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ইন্টারনেট বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান করে থাকেন। এতে পাঠ্যবই, ভিডিও, অডিও ও ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ই-লার্নিংয়ের ব্যবহার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উন্নতির দিকে গেলেও উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্য বেশ বড়। উন্নত দেশগুলো বহু আগেই ই-লার্নিং ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাকে শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
উন্নত দেশের চিত্র
উন্নত দেশগুলোয়, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান ইত্যাদিতে প্রাথমিক শিক্ষায় ই-লার্নিং ও ডিজিটাল প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ট্যাবলেট, কম্পিউটার, স্মার্টবোর্ড ইত্যাদি ব্যবহার করে ক্লাসের পাঠ বুঝতে পারে এবং অনলাইন অ্যাপ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে অতিরিক্ত শেখার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ইন্টারঅ্যাকটিভ ভিডিও টিউটোরিয়াল, ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুম ও ডিজিটাল পাঠ্যপুস্তক। এসব দেশের স্কুলে শিক্ষার্থীরা বাড়িতেও অনলাইনে শিক্ষকদের সাহায্য নিতে পারে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরেও বিশ্বব্যাপী শেখার সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ই-লার্নিংয়ের প্রসার শুরু হয়েছে মূলত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায়। কিছু শহুরে স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে, যেখানে প্রজেক্টর, স্মার্টবোর্ড ও ল্যাপটপ ব্যবহার করে শিক্ষাদান করা হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাইমারি এডুকেশন ডিজিটাইজেশন প্রজেক্ট’ ও বিভিন্ন ই-লার্নিং অ্যাপ চালু করেছে। উদাহরণস্বরূপ ‘মুক্তপাঠ’ ও ‘শিখন’ প্ল্যাটফর্ম দুটি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার্থীদের জন্য ই-লার্নিংয়ের সামগ্রী সরবরাহ করে।
তবে প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো ইন্টারনেট ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলের স্কুলগুলোয় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা এখনো সবার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশের ২০১৯ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৬৪ হাজার ৮৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বেশির ভাগেই ডিজিটাল ক্লাসরুমের সুবিধা নেই। এমনকি যেসব স্কুলে ডিজিটাল ক্লাসরুম আছে, সেখানেও শিক্ষকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতার অভাব থাকায় এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।
চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি। গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোয় প্রায়ই কম্পিউটার ল্যাব বা পর্যাপ্ত ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়া যায় না, যা ই-লার্নিং কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও উন্নয়নমূলক উদ্যোগের ফলে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার প্রসার ঘটছে। ‘শিক্ষা উপকরণ মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট’ তৈরি ও শিক্ষকদের জন্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে, যা শিক্ষকদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯–এর সময় ‘শিক্ষা টেলিভিশন’ ও অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়, যা ডিজিটাল শিক্ষার প্রসারে একটি বড় পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে উন্নত দেশের তুলনায় এখনো অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে। এ ব্যবধান কমাতে উন্নত অবকাঠামো, ইন্টারনেট সংযোগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির প্রসারে সরকার–বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।
লেখক: শারমিন ইসলাম, সহকারী শিক্ষক, পঞ্চবটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ।