প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনায় ঈদে ঘরে ফেরার ব্যবস্থা কী সম্ভব

ট্রেনের জন্য অধীর অপেক্ষা। তবুও চাই ঈদে ঘরে ফেরা। কমলাপুর স্টেশন, ঢাকাফাইল ছবি: সুমন ইউসুফ

আগামী রোববার পবিত্র ঈদুল আজহা। যাকে আমরা কোরবানির ঈদও বলি। শুরু হয়ে গেছে মানুষের ঘরে ফেরার পালা। তবে এ ফেরার যাত্রা সব সময় আনন্দের হয় না। কেননা, দুর্ঘটনার ভয় তো আছেই। আবার রাস্তার যানজট যাত্রাকে অনেক সময়ই বিষিয়ে তোলে। এ থেকে মুক্তি দরকার। যাতায়াত সুবিধার জন্য সরকার ইতিমধ্যে নানা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে বটে। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদ ছাড়াও প্রায় সময়ই ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় চলে যাচ্ছে মানুষের। সমাধানের জন্য চলমান পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন। তেমন সম্ভাব্য কয়েকটি নিচে প্রস্তাব তুলে ধরছি। সরকার চাইলে তা বিবেচনায় নিতে পারে। প্রস্তাবনায় দুটি অংশ রাখছি। প্রথম অংশটির বাস্তবায়ন হবে অফিসিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে এবং ট্রাফিক পুলিশের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। দ্বিতীয়টি চলবে প্রযুক্তির মাধ্যমে।

শুরুতেই প্রথম ধাপের আলোচনায় আসি। এ অংশে মূলত গতানুগতিক সংস্কারমূলক প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তাব হলো, সব ঈদের সময়েই বাড়ি ফেরার জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক সপ্তাহ আগেই ছুটি দিতে হবে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিড় শুরুর আগেই বাড়ি ফিরতে পারবেন। এতে রাস্তার চাপও কমবে।

দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক কারখানা (গার্মেন্টস) বা এ রকম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ কম। তাদের শেষ বেলা অবধি কাজ থাকে। তাই তাদের দুই ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। যারা দূরের, তাদের এক পদ্ধতিতে ঢাকা ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের ধাপে ধাপে ছুটি দেওয়া যেতে পারে। অথবা কয়েকটি কোম্পানিগুচ্ছ আকারে তাদের কর্মীদের কোনো এক দিনে ছুটি দেবে তো অন্য আরও কিছু কোম্পানি মিলে পরের দিন তাদের কর্মীদের ছুটি দেবে। এভাবে তারা কয়েক দিনে তাদের দূরের কর্মীদের বাড়ি পাঠাতে পারে। আর যারা ঢাকার কাছে, যেমন গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা বা টাঙ্গাইলের, তাদের ঈদের দুই দিন আগের বিকেল থেকে বাড়ি ফেরার সুযোগ দেওয়া হবে। শ্রমিকেরা ঢাকায় ফিরবেও পর্যায়ক্রমে সম পরিমাণ ছুটি ভোগ করে।

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে আজ শুক্রবার ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা একটি পরিবার
ফাইল ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কোনো মোটর বাইককে বড় রাস্তায় উঠতে দেওয়া যাবে না। তারা কেবল বিভিন্ন বাইপাস বা ছোট রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরবে। একইভাবে অটো রিকশাগুলোকেও বড় রাস্তায় উঠতে দেওয়া যাবে না। সম্ভব হলে সিএনজিচালিত অটোরিকশাকেও সে সময়ে বড় রাস্তা ধরে চলার নিষেধ করা যেতে পারে।

ঈদের তিন দিন আগে থেকে দিনের বেলায় কোনো ট্রাক বা মালবাহী গাড়িকে চলতে দেওয়া যাবে না। গরু বহনকারী গাড়িগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রজোয্য হবে। তারা কেবল রাত ৯টার পর মালামাল বহন করতে পারবে। নিশ্চিত করতে হবে যে রাস্তার পাশে কোনো গরুর হাট বা ফেরি-দোকান বসতে পারবে না। কারণ প্রতি বছরই এমন নিয়ম থাকলেও, বাস্তবায়নে ঘাটতি দেখা যায়। গরুর হাট বসবে বড় রাস্তা হতে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দুরে। এটি কঠোরভাবে মানতে হবে।

এবার আসি আমরা কীভাবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সহজেই বাড়ি ফিরতে পারি। সেই বিষয়ে। এ ধাপে প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো ঢাকার সব মানুষকে ট্রাফিকের কাছ থেকে বাড়ি ফেরার অনুমতি নিয়ে বাড়ি আসতে হবে। অনুমতি নেওয়ার কথা শুনেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা খরচা করেই আমরা সেই সুবিধা পেয়ে যাব। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের একটি নিজস্ব অ্যাপস থাকবে। ঢাকা ছাড়তে আগ্রহী মানুষ বা তার পরিবারের যেকোনো একজন তাদের একটি মোবাইল থেকে ট্রাফিক নির্ধারিত নম্বরে মেসেজ পাঠাবে, কিংবা ট্রাফিক অ্যাপসে লগইন করে বাড়ি ফেরার জন্য আগ্রহ ফর্ম পূরণ করবে। দুই ক্ষেত্রেই ভ্রমণেচ্ছুকের প্রদেয় তথ্য ট্রাফিক অ্যাপসে গিয়ে পৌঁছবে। ট্রাফিক অ্যাপস সেই তথ্য যাচাই করবে। তথ্যের মধ্যে থাকবে মোট ভ্রমণকারীর সংখ্যা, চাকরিজীবী কি না, চাকরীজীবী হলে পদবি, গন্তব্য জেলা, কখন এবং কোনো তারিখে যেতে আগ্রহী। চাকরির তথ্য নেওয়া হবে এ জন্যে যে প্রয়োজন হলে তাদের চাকরির ধরণ অনুযায়ী ভাগ ভাগ করে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করা যাবে।

বাসের ছাদে উঠেই ঘরে ফেরা। ছবিটি রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে তোলা
ফাইল ছবি: জাহিদুল করিম

ট্রাফিক অ্যাপস তার আবেদনের ভিত্তিতে ট্রাফিকের করা পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট গন্তব্য পথে আবেদনকারীর জন্য ভ্রমণ তারিখ নির্ধারণ করবে। সম্ভব হলে আবেদনকারীর চাওয়া তারিখটিকে নির্বাচন করা হবে। নতুবা অপেক্ষমাণ তালিকায় রেখে পরবর্তী কোনো নিকটতম দিবসে তার বাড়ি ফেরার তারিখ নির্ধারণ করা হবে। তারিখ নির্ধারিত হলে আবেদনকারীকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। আর এদিকে বাসগুলো ভ্রমণকারীর মোবাইলের মেসেজ দেখে টিকিট বিক্রি করবে ও তাদের বাসে যাত্রী উঠাবে। তাতে টিকেট নিয়ে হাঙ্গামাও থাকবে না। কেননা, ট্রেন ও বাসের আসন সংখ্যার তথ্য পর্যালোচনা করেই ট্রাফিক পুলিশ কোন এক রাস্তায় এক দিবসে সর্বোচ্চ যাত্রীর যাত্রার অনুমতি দিবে। কোনো যাত্রী অনুমতি নিয়ে নির্ধারিত দিবসে নাও যেতে পারে কিংবা অনেকেই বাস-ট্রেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরতেও কোনো অনীহা করবে না; সেটা বিবেচনায় রেখে প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি মানুষকে এক দিবসে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এভাবে অনুমতি নিয়ে চলার বিষয়টি বাস মালিক সমিতি মানছে কি না সেটা যাচাই করার জন্য ট্রাফিক পুলিশও দৈব চয়ন ভিত্তিতে যাত্রীর মেসেজ চেক করে দেখবে। আগেই বলেছি, একদিনে কোনো এক সড়কে সর্বোচ্চ কতজন নির্ভেজাল যতায়াত করতে পারবে ট্রাফিক পুলিশের কাছে সেই তথ্য আগেই জমা থাকবে। ধরে নিলাম যে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ রাস্তায় একদিনে এক লাখ লোক যাতায়াত করতে পারে। তাহলে কোনো এক দিবসে ময়মনসিংহে আসতে চাওয়ার আবেদনকারীদের সংখ্যা এক লাখ হয়ে গেলে ট্রাফিক অ্যাপসটি সেদিনের জন্য আর কোনো আবেদন মঞ্জুর করবে না। তাদের অপেক্ষমাণ রেখে পরের দিন ফেরার সুযোগ করে দিবে। এভাবে চাইলে ট্রাফিক পুলিশ একটি অ্যাপস দিয়ে ট্রাফিক ফ্লো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাতে মানুষের দুর্ভোগ কমবে। তখন সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে মানুষের মধ্যে দলবেঁধে যাতায়াত করার প্রবণতা কমবে। তাহলে যে যখন সুযোগ পাবে সে কেবল তখনই বাড়ি আসতে পারবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে হওয়ায় বিষয়টি বেশ সুশৃঙ্খল হবে। ফেরার ক্ষেত্রেও একইভাবে অ্যাপস–এর সাহায্য নিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে অ্যাম্বুলেন্স, খাদ্য বা ডাকবাহী গাড়ীকে এবং কিছু জরুরি সেবা-দানকারী গাড়িকে অ্যাপসের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনের আওতার বাহিরে রাখতে হবে।

প্রযুক্তিগত শেষ পদ্ধতিটির উদ্দেশ্য হলো যানজন এড়িয়ে চলা। এক্ষেত্রে ঢাকার পরিধি বরাবর কিছু মোড়ে ‘জ্যাম লাইট’ নামক এক ধরের বিশেষ ল্যাম্প পোস্ট লাগানো হবে। তেমনি ল্যাম্প পোস্ট থাকবে দূরের শহরগুলোর প্রবেশ মুখেও। মূলত লাইটের সংখ্যা কমপক্ষে দুটি করে থাকবে। যার একটি বুঝাবে লোকাল যানজট, অন্যটি বুঝাবে ওই রাস্তার শেষ প্রান্তে যে গন্তব্য-শহর সেখানকার যানজট। ওই রাস্তার সাথে একাধিক বড় শহরের গন্তব্য-সংযোগ থাকলে সেখানে প্রতিটি শহরের নাম লেখা বাল্ব বা আলাদা আলাদা বাল্ব পোস্ট থাকবে। যাতে করে লাইট জ্বললে সেই সম্পর্কিত শহরের নামটিও পড়া যায়। বাতির রঙ দুই রকম হবে। একটি রঙকে লোকাল যানজন অর্থে বুঝানো হবে। আর অন্যটিকে ব্যবহার করা হবে দূরেরে শহরের জ্যাম বুঝাতে। এ সিস্টেমে দেশের সব জ্যাম লাইটগুলো মোবাইল ডেটা বা অন্য কোনো ইন্টারনেট কানেকশন পদ্ধতিতে সংযুক্ত থাকবে। এর সুবিধা বুঝতে হলে নিচের উদাহরণটি দেখি।

যেমন ধরুন, ময়মনসিংহের বাইপাস মোরে বা ব্রিজে বড় ধরনের যানজট লেগে গেল। তাহলে সেখানকার ট্রাফিক পুলিশ রিমোট টিপে তার লোকাল জ্যাম লাইটটি জ্বালিয়ে দিল। আরও কল্পনা করুন, সেই সিগন্যাল সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে গেল গাজীপুর চৌরাস্তার মোড়ের লাইট কন্ট্রোল বক্সে। তখনি গাজীপুর মোড়ে স্থাপিত ময়মনসিংহের জন্য নির্ধারিত লাইটটি জ্বলে উঠল। তাতে করে গাজীপুর চৌরাস্তায় বসেই ড্রাইভার বুঝতে পারবে যে ময়মনসিংহে বড় যানজট লেগেছে। এর সুবিধাটা হলো, তখন পরিস্থিতির সুবিধা নিতে নেত্রকোণাগামী গাড়িটি জয়দেবপুর পর্যন্ত আসার পর বিকল্প হিসেবে কিশোরগঞ্জের হুসেনপুরের ভেতর দিয়ে নান্দাইল হয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। কিংবা ত্রিশালে পৌঁছে বালিপাড়া ও নান্দাইল দিয়ে নেত্রকোণা চলে যাবে। শুধু তাই নয়, সেসব লাইট দেখে ট্রাফিক পুলিশও তার কাজের একটা ডিরেকশন পাবে। জ্যাম লাইট দেখে ট্রাফিক পুলিশ তখন গাড়িগুলোকে বিকল্প পথে নিতে পারবে।

ঈদের যাত্রার দুর্ভোগ কমানোর জন্য এমন সব প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন হলে তা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। সরকার চাইলে তথ্য প্রযুক্তিবিদদের মতামত নিয়ে আরও সম্ভাবনার পথ বের করতে পারে। সেই সঙ্গে এসব টেকনোলজির ব্যবহার দেশকে অন্যদের কাছে নতুন করে চেনাবে। দেশও এগিয়ে চলবে। জানি এ ঈদে হয়তো তার সবই হবে না। কিন্তু পরিকল্পনাতো চাই। সবার জন্য রইল ঈদ মোবারক এবং শুভ কামনা যেন স্বাচ্ছন্দময় হয় ঈদ যাত্রা।

*লেখক: অধ্যাপক এ. এইচ. এম. কামাল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]