পর্যটনে সম্ভাবনাময় শরীয়তপুর

পদ্মা সেতুর বদৌলতে পাল্টে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জনপদ। নতুন সম্ভাবনার দার উন্মোচিত হচ্ছে এ অঞ্চলকে ঘিরে। পদ্মা সেতুসংলগ্ন এবং ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় শরীয়তপুর হতে পারে নিকট ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় পর্যটন নগরী।

পদ্মাপারের এ জেলার আত্মপ্রকাশ ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। জেলাটির মোট আয়তন প্রায় ১ হাজার ১৮১ বর্গকিলোমিটার। এ জেলার উত্তরে মুন্সিগঞ্জ, দক্ষিণে বরিশাল, পূর্বে চাঁদপুর ও পশ্চিমে মাদারীপুর জেলা অবস্থিত। জেলার ব্যান্ডিং হলো সোনালি সেতুর শ্যামল ভূমি।

বাংলাদেশের যে কয়টি জেলা অনগ্রসর এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল, তার মধ্যে প্রথম সারির একটি হলো শরীয়তপুর। এ জেলায় নেই কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল কলেজ, চার লেনের রাস্তা, ট্রেন যোগাযোগ, উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামাতেই পরিবহন পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। ভালো হাসপাতাল না থাকায় চিকিৎসা পেতে কাঠগড় পোড়াতে হয়। এ কারণে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে পাড়ি জমাতে হয় ঢাকায় কিংবা পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয়। এতে অবর্ণনীয় ভোগান্তির স্বীকার হতে হয় এসব মানুষকে। পথে রোগীর মৃত্যু ঘটে—এমন নজির নেহাত কম নয়।

কিন্তু আনন্দের বিষয় হলো, পদ্মা সেতু কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলাটির দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে শুরু করছে খুব দ্রুততার সঙ্গে। একসময়ের সবচেয়ে অবহেলিত এ জেলাতেই এখন নতুন দিগন্তের দার উন্মোচিত হচ্ছে। পদ্মা সেতুর সুফলভোগী দক্ষিণাঞ্চলের যে কয়টি জেলা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শরীয়তপুর। ইতিমধ্যে সরকারের সুনজর পড়তে শুরু করছে অবহেলিত এ জেলায়। সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্মাসংলগ্ন এ জেলায় বিনিয়োগ শুরু করে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে, অর্থাৎ শরীয়তপুরের জাজিরাতে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল, মোটেলসহ বিলাসবহুল বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।

সরেজমিন দেখা গেছে, সেতুর আশপাশে অনেক এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জমি কিনে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে।

এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। জাজিরা থেকে সদর পর্যন্ত রেললাইন, পদ্মা সেতু থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত চার লেন সড়ক এবং মনোহরবাজার থেকে আলুরবাজার ফেরিঘাট পর্যন্ত চার লেন সড়ক। শরীয়তপুরে শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর সঙ্গে শরীয়তপুরবাসীর সড়কপথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইতিমধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে শরীয়তপুর ফায়ার সার্ভিস থেকে কাজিরহাট পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ, কাজিরহাট সেতু ও কোটাপাড়া নদীর ওপর সেতুর কাজ চলমান। এ ছাড়া জেলাটিতে একটি আধুনিক বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বিমানবন্দর হলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে পর্যটকেরা সহজেই ভ্রমণ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন ঘটবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শরীয়তপুর জেলা শহরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের নির্মাণকাজ চলমান। এ জেলায় প্রথম শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গীর মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে।

পদ্মার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল শরীয়তপুরের জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের পাইনপাড়া এলাকায় পদ্মার মাঝেরচরে সহস্রাধিক পরিবারকে সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য উপজেলার চরাঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

পদ্মা সেতু ও এর আশপাশের এলাকা নিরাপদ রাখতে জাজিরায় সম্প্রতি শেখ রাসেল সেনানিবাস গড়ে তোলা হয়েছে। সেনানিবাসটিতে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ। ফলে, পর্যটন এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে ‘পদ্মা দক্ষিণ’ নামে একটি থানা গড়ে তোলা হয়েছে পদ্মা সেতুর কাছে।

অর্থাৎ একটা পর্যটন নগরী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
গত ঈদে দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে লাখ লাখ পর্যটনকের ভিড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ জড়ো হয় সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে। ফলে, একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, সেই সঙ্গে অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার পাচ্ছে রাজস্ব।

পর্যটনে সম্ভাবনার বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মার দুই পাশেই হংকং-সাংহাইয়ের মতো শহর গড়ে উঠবে। সেখানে বড় বড় শহর হবে, বড় বড় রিসোর্ট হবে। এখানে যদি আমরা প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করি, তাহলে ঢাকার যে ডিমান্ড, সেটা ওখানেই পূরণ করা যাবে। সে জন্য আমাদের একটা মেগা পরিকল্পনা থাকা উচিত যে আমরা কীভাবে ওই এলাকা সাজাব।’

তাই দেশের অর্থনীতির গুরুত্ব বিচার করে এবং পর্যটন খাতকে আরও ত্বরান্বিত করতে সরকারি চলমান প্রকল্পগুলো যথাসম্ভব দ্রুত শেষ করতে হবে। তাহলে জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেমন শরীয়তপুরের নড়িয়ায় রামঠাকুরের আশ্রম, কোলকাঠির ফ্যান্টাসি কিংডম, বুড়িরহাটের ঐতিহাসিক মসজিদ, সুরেশ্বর দরবার শরিফ, চিশতিনগর দরবার শরিফ, ভেদরগঞ্জের ৬০০ বছরের পুরোনো মহিসার দিগম্বরের দিঘি, ছয়গাঁও, কার্তিকপুর, হাটুরিয়া জমিদারবাড়ি, দেড় শ বছরের পুরোনো সদরের রুদ্রকর মঠ, ধানুকা মনসাবাড়ি, নড়িয়ায় গীতিকার অতুল প্রসাদ সেনের বাড়ি, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মানসিংহের দুর্গসহ নানা দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এসব স্থানে পর্যটকদের আগমন আরও বাড়বে।
*লেখক: মোহাম্মদ ইসমাইল জাবিউল্লাহ, সখীপুর, শরীয়তপুর