পদ্মা সেতু: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য উৎসব ও প্রেরণার। ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। পদ্মা সেতু এখন আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। বাংলাদেশ যে ‘পারে’, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে তা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে সগৌরবে বলতে পারছি, ‘আমরাও পারি।’ পদ্মা সেতু যে রকম দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, ঠিক সেভাবে আমাদের মনোবল ও সাহস জোগাচ্ছে। অদম্য মানসিক দৃঢ়তা এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমরা মনে করি, আমাদের কোনো কিছুতেই আর দাবায়ে রাখা যাবে না। একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সেটারই কিন্তু আরেকটা নিদর্শন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
অর্থনীতির কথা যদি আমরা বলি, আমরা খুব ভালো করে জানি যে দীর্ঘদিন ধরে এই দক্ষিণাঞ্চল রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আর শুধু এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলের এই বিশাল ভূখণ্ড নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। খুলনা-সাতক্ষীরা-যশোর বা পটুয়াখালী-বরিশাল-বরগুনায় যাতায়াতে ৮-১০ ঘণ্টা সময় লাগত। অনেক সময় তার চেয়ে বেশি সময় লাগত, সেটা এখন মাত্র চার ঘণ্টায় সম্ভব হবে। ফলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চল থেকে উৎপাদিত কৃষিপণ্য অতি সহজেই, অল্প সময়ে তা রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। ফলে কৃষক পণ্যের যথাযথ মূল্য পাবে এবং নানাভাবে উপকৃত হবে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে একসময় যে শিল্পায়নের গতি ছিল, সেই গতি কিন্তু সময়ের সঙ্গে হারিয়েছে। আমরা সেই গতি আবারও ফিরে পাব বলে আশা করছি।
আমরা জানি, মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক শিল্পায়নের যে প্রক্রিয়া চলছে এবং এ বন্দরের উন্নয়নে যে মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, এর ওপর পদ্মা সেতু সরাসরি প্রভাব রাখবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর পরোক্ষ ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে নানা ক্ষেত্রে। বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে, তার মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য।
অর্থনীতিবিদদের মতে, পদ্মা সেতু ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ, এ অঞ্চলে যখন শিল্পায়ন হবে, সেই শিল্পায়নের একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দেশের উপকূলীয় এলাকা। আমরা কক্সবাজার, মহেশখালী ও সন্দ্বীপে যে ধরনের উন্নয়ন দেখছি, তাতে বলতে পারি, উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। সেই উন্নয়নের রোডম্যাপে আমরাও কিন্তু যুক্ত হয়েছি। পদ্মা সেতু আমাদের মোংলা পোর্ট ও এ অঞ্চলের শিল্পায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমি মনে করি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা অঞ্চলে অন্যান্য যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোতে সবার জন্য কিন্তু নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। এখন আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই শিল্পবিপ্লবের প্রয়োজনে আমাদের যে দক্ষ জনশক্তি দরকার, তা গড়ার ভূমিকা তো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই নিতে হবে। এই পদ্মা সেতুকে আমরা সামনে ধরে রেখে আমাদের যে উন্নয়নপ্রক্রিয়ার শুরু, সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন আমরা চলতে পারি। সে জন্য আমাদেরও অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা দিতে হবে, যেগুলো আসলেই শিল্পায়ন ও বিশ্বায়নের যুগে যেন যথাযথভাবে কাজ করতে পারে।
আমরা যখন পর্যটনশিল্পের কথা বলি, তখন কক্সবাজারের কথাই উঠে আসে। প্রতিবছর বিভিন্ন সময় সেখানে পর্যটকদের ঢল নামে। কিন্তু সেই অর্থে আমাদের সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, যার প্রতি বিশ্ব আকৃষ্ট এবং এটা ন্যাচারাল হেরিটেজ সাইট, সেই অনুযায়ী এখানে পর্যটকেরা আসছেন ঠিকই, কিন্তু খুব বেশি নয়, যতটা আমরা আশা করছি। এর অন্যতম কারণও কিন্তু এই যোগাযোগব্যবস্থা। আমরা যতটুকু দেখতে পাই, পদ্মা সেতু চালু হলে সুন্দরবনের সঙ্গে পদ্মার ওপারের মানুষের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।এ ছাড়া বাগেরহাট থেকে মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা পর্যন্ত সুন্দরবনের যে পূর্ব অংশ, সেখানেও কিন্তু সরাসরি যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে। এতে পর্যটনশিল্পে একটা অবারিত সম্ভাবনা দেখা দেবে। এ সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা।
পদ্মা সেতু চালু হলে অবশ্যই পর্যটকদের সমাগম বাড়বে। পাশাপাশি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও তার যে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য, তার যে ইকোলজিক্যাল সার্ভিসগুলো রয়েছে, অধিক পর্যটক ও অপরিকল্পিত পর্যটনের কারণে যেন সেগুলোর ক্ষতি না হয়। সে জন্য পর্যটককে অবশ্যই আমরা আহ্বান জানাব, পাশাপাশি যথাযথ পর্যটনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবকাঠামোগত ও আইনগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ম্যাস টুরিজম না করে কন্ট্রোল ইকোট্যুরিজমের দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ফলে আমাদের সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল যে জনগোষ্ঠী রয়েছে, তারাও উপকৃত হবে। এই ইকোট্যুরিজমে তারাও নানাভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবে।
আসলে যখন পর্যটক কোনো একটি জায়গায় আসেন, তখন তিনি চিন্তা করেন, ‘একটি এলাকায় গিয়ে আমি কতগুলো নিদর্শন দেখতে পারব।’ সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে শুধু সুন্দরবন নয়, সুন্দরবনের আশপাশে আরও অনেক পর্যটনস্থান রয়েছে। বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ, পীর খানজাহান আলী (রহ.)-এর মাজার রয়েছে, এদিকে দক্ষিণডিহি রয়েছে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য স্থান হলো কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। এই পুরো অঞ্চল ধরে তথা সুন্দরবন, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর ও কুয়াকাটা মিলে একটা পর্যটন অঞ্চলে পরিণত হবে। আশা করা যায়, অর্থনৈতিকভাবে পদ্মা সেতু এই পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষেরও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এ ছাড়া আমাদের স্বাস্থ্যসেবারও মান বাড়বে। উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে সহজে মানুষ ঢাকায় যেতে পারবে। আবার ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা খুলনায় এসে চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বিভিন্নমুখী সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য আরও কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। তার মধ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে ফকিরহাটের টাউন নওয়াপাড়ার মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করে চার বা ছয় লেনে উন্নীত করা, টাউন নওয়াপাড়ার মোড় থেকে পিরোজপুর অভিমুখী সড়ক বাগেরহাট পর্যন্ত চার লেনে উন্নীত করা। অনুরূপভাবে টাউন নওয়াপাড়ার মোড় থেকে মোংলা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক ছয় বা আট লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ভোমরা স্থলবন্দর ও মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত চার লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে খানজাহান আলী বিমানবন্দরও চালু করা দরকার। কেননা, এখানে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী ও পর্যটক আসবেন। তাঁরা চাইবেন সরাসরি খানজাহান আলী বিমানবন্দরে পৌঁছাতে। বিভিন্নমুখী ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলে হোটেল-মোটেলের সুবিধাও দরকার হবে। এ বিষয়গুলোও পরিকল্পনায় নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা দরকার।
লেখক: মাহমুদ হোসেন, উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়