পদ্মা সেতু ও আমাদের পর্যটনশিল্প
সব বাধা পেছনে ফেলে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা গর্বিত। দৃঢ় মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, বাঙালি সেটা আবার প্রমাণ করে দেখাল। একসময় এ দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া হলেও পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আমরা দেখাতে সক্ষম হয়েছি যে আমরাও পারি। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল প্রকল্প বাংলাদেশের সক্ষমতাকেই তুলে ধরে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এ সেতু দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নব দিগন্ত উন্মোচন করবে। মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় আসতে পারবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ যোগাযোগে পিছিয়ে থাকলেও স্বপ্নের পদ্মা সেতু তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ভূমিকা রাখবে। এত দিন এ অঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় ফেরিই ছিল একমাত্র ভরসা। বৈরী আবহাওয়ায় ফেরি চলাচল অনেক সময় ব্যাহত হতো। ফেরিতে করে কৃষকের যত্নে ফলানো শস্য, ফলমূল, শাকসবজি রাজধানীতে পৌঁছানো ছিল কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
দক্ষিণ অঞ্চলে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকলেও যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পর্যটনশিল্পও তেমন এগোয়নি। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, দ্বীপজেলা ভোলা, মোংলা বন্দর, পায়রা বন্দর, সুন্দরবনসহ দক্ষিণের চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যেতে পর্যটকদের পোহাতে হয় দুর্ভোগ। এখন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পর্যটকেরা সহজেই এসব চিত্তাকর্ষক স্থানে পৌঁছাতে পারবেন। ফলে এগিয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন। দেশের অর্থনীতি হবে বেগবান। বেকারত্বের হার কমে আসবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু যোগাযোগব্যবস্থায় নব দিগন্ত উন্মোচন করবে না, পর্যটনশিল্পের পালে বইবে পরিবর্তনের হাওয়া। পদ্মা সেতু জাদুঘর হবে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এখানে পদ্মা অববাহিকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত নানা প্রজাতির প্রাণীর নমুনা রাখা হচ্ছে, যা পর্যটকদের মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি নতুন কিছু দেখার ও শেখার সুযোগ করে দেবে। অন্যদিকে পদ্মার ইলিশ খাওয়ার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা। পদ্মাপাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগের আনন্দ পর্যটকদের বারবার এখানে নিয়ে আসবে।
পদ্মার দুই পাড়ে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্টসহ নানা স্থাপনা। এখনকার মানুষের চিন্তায় লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। অনেকে পর্যটনে বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখছে। শুধু স্থানীয় লোকজন নন, প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকেরা আসছেন। অনেকে ব্যস্তসময় থেকে সময় বের করে পরিবার–পরিজন নিয়ে এখানে এসে ছবি তুলছেন, ঘুরে ঘুরে চারদিকের দৃশ্য উপভোগ করছেন, যা আগামী দিনগুলোতে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনাকেই সামনে নিয়ে আসে। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ নয়, পুরো দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দারিদ্র্যের হারও কমে যাবে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে দেশমাতৃকা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্রিজ বা সেতুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন। নদীর পাড়ে সময় কাটাতে যে কারোরই ভালো লাগে। নদীপাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মনে আনে প্রশান্তি। তাই তো উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্রিজগুলো বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুও আলো ছড়াবে বিশ্ববাসীর হৃদয়ে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে পর্যটনশিল্পে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, যাতে এখানে একটি পর্যটনবান্ধব পরিবেশে গড়ে ওঠে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন অনেক দূর এগিয়ে নেবে। তাই সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে সুযোগ করে দিতে হবে।
প্রমত্ত পদ্মার ওপর দিয়ে অল্প সময়ে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় যাবে, এটি একসময় স্বপ্নের বিষয় হলেও এখন তা বাস্তব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির অপেক্ষায় থাকতে হবে না ঘরমুখী মানুষদের। ঈদের সময় তাদের পোহাতে হবে না দুর্ভোগ। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে তৈরি হবে মৈত্রী। পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। পুরো জাতি এখন তাকিয়ে আছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দিকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চোখ বুলালে পদ্মা সেতুর প্রতি বাঙালির অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আবেগ চোখে পড়ে। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় জমাচ্ছেন পদ্মার দুই পাড়ে। শুধু পদ্মার পাড়ে ভিড় জমানো নয়, বিভিন্নভাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছে মানুষ। সম্প্রতি দুই তরুণ-তরুণী পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন বিয়ে করবেন বলে ঘোষণা দেন।
পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নেওয়ায় দেশের পর্যটন সম্ভাবনা বেড়েছে বহুগুণ। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন এগিয়ে নিতে প্রথম যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, তা হলো পরিকল্পিত পর্যটন গড়ে তোলা। পর্যটকদের জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। অবকাঠামো তুলতে গিয়ে সেতু বা সেখানকার পরিবেশ যেন বিনষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। মোদ্দাকথা, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন যেন পরিকল্পিত পর্যটন হয়। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ যোগাযোগে দীর্ঘদিন পিছিয়ে থাকলেও এবার তাদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। শোনা যাচ্ছে, অনেকেই পেশা বদল করে পর্যটনশিল্পে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ শিল্প লাভজনক হওয়ায় লোকজন পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটনকে কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজছেন। এ ক্ষেত্রে সবাইকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদল নয়, এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির চেহারা বদলে দেবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া