পতিসরে রবীন্দ্রস্মৃতি

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষি সমবায় ব্যাংকের (১৯০৫) হিসাবের খাতা
ছবি: এম মতিউর রহমান মামুনের সৌজন্যে

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব জমিদারির অংশ পতিসরের সদর কাছারিবাড়ি। এটি একটি প্রত্নসম্পদ। এখানে উদ্ধার হওয়া অনেক রবীন্দ্রস্মৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনন্দ ও গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি আমার উদ্ধার করা কবির হাতের লেখা চিঠি, কৃষি ব্যাংকের হিসাবের খাতা, টি-পট, জমিদারির লোহার সিন্দুক, নাগর বোটের দরজা-জানালা, আরামকেদারাসহ আরও নতুন কিছু রবীন্দ্রস্মৃতি সংযোজনে রবীন্দ্র–জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এসব স্মৃতিচিহ্ন রবীন্দ্রগবেষকদের যেমন নতুন ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করবে, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব স্মৃতিচিহ্ন আমাদের আনন্দ আর গর্বকে বাড়িয়ে দেবে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিবেচনায় বিশ্বকবির প্রতিষ্ঠিত ‘কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন’-এর গুরুত্ব কোনোভাবেই কম নয়। তৎকালীন নির্মিত মাটির ঘর, কবির দেওয়া আশীর্বাণী, প্রজাদের উদ্দেশে দেওয়া শেষ অভিভাষণ, কালীগ্রাম পরগণার শেষ জমিদার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠির আবেদন তো আরও অনেক বেশি।

১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে দেওয়া কবির অবিনাশী বাণী আজ দেশের প্রচলিত শিক্ষা আইন প্রণয়নে দিকনির্দেশক হতে পারে। প্রজাদের উদ্দেশে দেওয়া সেদিনের ভাষণ, পতিসর তথা বাংলাদেশে দেওয়া কবির শেষ ভাষণ ছিল। এসব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রবীন্দ্রপরবর্তী কালীগ্রাম পরগনার শেষ জমিদার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠিগুলোও রবীন্দ্র-জমিদারির ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।

ইতিহাসবিদেরা এসব নিয়ে না ভাবলেও, সুধী গবেষকদের কলমে কালি না ঝরলেও আর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করুক আর না করুক, সেসব আমাদের ইতিহাসে অনেক গুরুত্ব বহন করে। বলা প্রয়োজন, কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের অরক্ষিত বিপুল রবীন্দ্রস্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের অনেক দায় রয়েছে।

কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠি
এম মতিউর রহমান মামুনের সৌজন্যে

আমরা মনে করি, উদ্ধার করা রবীন্দ্রস্মৃতি কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রথাসিদ্ধ সংগ্রহশালা করতে পারলে তা শান্তিনিকেতনের মতোই আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। সেই বোধ থেকেই ২০১৩ সালের ৮ মে বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকীতে কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন একটি রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা তৈরি করে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মৃতি সংরক্ষণ করেছি।

বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় পতিসরসংক্রান্ত কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক, অনুরাগী ও অনুসারীদের উজ্জীবিত মনে হয়েছে। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের গবেষকেরা রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা পরামর্শও দিয়েছেন কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনকে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা করে তা আর্কাইভের আওতায় নেওয়ার জন্য। আবার হতাশা প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ফেলে যাওয়া জায়গাজমি অবৈধ দখলদারি নিয়ে। জানতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর কোনো নিদর্শন কোথায়, কীভাবে আছে, সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব কি না? গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠিগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে সংরক্ষণের জন্য।

বেশ কিছুদিন আগে পতিসর ঘুরে গেলেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ টি ও কলিন, অধ্যাপক ক্যাথলিন এম ও কলিন, জার্মানের কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রগবেষক গোলাম আবু জাকারিয়া, অধ্যাপক এল কে জাকারিয়া, অধ্যাপক এফ লিংক, গোমার্চবাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুজিত কুমার চৌধুরী প্রমুখ। গবেষকেরা পতিসরে রবীন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয় উল্লেখ করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বকবির ফেলে যাওয়া বিষয়সম্পত্তি দিয়ে ‘রবীন্দ্র কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ড’ গঠন করার।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল সংসার থেকে বিদায় নেওয়ার আগে প্রিয় পরগনার প্রিয় প্রজাদের শেষবারের মতো দেখে যাবেন। কবির সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই নদীপথে পতিসরে এসেছিলেন। সেদিন অসুস্থ কবি খেটেখাওয়া হাজার হাজার প্রজার উদ্দেশে ভাষণ দেন। অসুস্থ কবির অশ্রুসিক্ত ভাষণের অংশবিশেষে যা লেখা ছিল, তা হচ্ছে—

‘সংসার থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা ছিল; তা আজ পূর্ণ হল। তোমরা এগিয়ে চল জনসাধারণের জন্যে। সবার আগে চাই শিক্ষা, এডুকেশন ফাস্ট। সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও। ইচ্ছা ছিল মান-সম্মান-সম্ভ্রম সব ছেড়ে দিয়ে তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতোই সহজ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী করে বাঁচতে হবে তোমাদের সঙ্গে মিলে সেই সাধনা করব। কিন্তু আমার আর এ বয়সে তা হবার নয়। এই নিয়ে দুঃখ করে কী করব? আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখ। আমি তোমাদেরকে বড় ভালোবাসি, তোমাদের দেখলে আমার আনন্দ হয়, তোমাদের কাছে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। কিন্তু কিছুই তোমাদের দিতে পারিনি—আশীর্বাদ করি, তোমরা সুখী হও। তোমাদের সবার উন্নতি হোক—এ কামনা নিয়ে পরলোকে চলে যাব।’

ওই দিনই প্রিয় পুত্রের নামে স্থাপিত বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে কবিগুরু লিখেছিলেন—

‘রথীন্দ্রনাথের নাম চিহ্নিত কালীগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্বন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয়—এই আমার উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন-পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম—এ কথা সর্বদা মনে রাখা উচিৎ। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মান হানিজনক। সাধারণত আমাদের দেশে অল্পবয়স্ক বালকগণ প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ হইয়া থাকে—এ কথা আমার জানা আছে। সেই কারণেই সতর্ক করিয়া দিলাম।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স যখন ৭৬, মৃত্যুর ঠিক চার বছর আগে পতিসর থেকে শেষবিদায় নিয়েছিলেন। সেদিন প্রজাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কবি কেঁদেওছিলেন। কেঁদেছিলেন হাজার হাজার প্রজা। ‘আমাদের ছোট নদী’খ্যাত সেই নাগর বয়ে নিয়ে গেল অশ্রুসিক্ত তার প্রিয় যাত্রীকে। এরপর কবির আর কখনো পতিসর তথা বাংলাদেশে আসা হয়ে ওঠেনি।

কবির মৃত্যুর পর কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ওপর জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৯৪৫ সালে, ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে, কবিপুত্র সস্ত্রীক পতিসরে আসেন। বাবার প্রিয় জমিদারি ও খেটেখাওয়া সাধারণ গরিব প্রজাদের শেষবারের মতো দেখা, নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে রথীন্দ্রনাথ উতলা ছিলেন। জমিদারি প্রথা যে বিলুপ্ত হবে, তা সময়ের ব্যাপার ছিল। তা হয়তো কবিপুত্র উপলব্ধি করেছিলেন।

পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আগপর্যন্ত কবিপুত্র সশরীরে পতিসরে না আসতে পারলেও জমিদারি ও কৃষি ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ, অডিট রিপোর্ট নিতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিঠি লিখেছেন বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে। জমিদারি বিলুপ্তির আগমুহূর্তে তিন বছরের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের প্রতিবেদন কবিপুত্রের হাতে এলে তাতে যে বড় রকমের গোলযোগ আছে, তা বুঝতে পেরে সংশোধন করতে বিশ্বস্ত ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে চিঠি লেখেন। চিঠিটি হুবহু তুলে ধরলাম—
‘কল্যাণীয়েষু,

তোমার চিঠি ও সেই সঙ্গে তিন বছরের বার্ষিক ষ্টেটমেন্ট যা অন্নদা তোমাকে দিয়েছে তা পেলুম। এর থেকে কিছু বোঝা যায় না। তবে দুটো বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তোমাকে জানাচ্ছি। ১৩৫৯ পর্যন্ত সাপোস এ/সি কিছু ছিল না। কিন্তু ১৩৬০ সালে সাসপেন্সে ৬,৬১৫/= জমার দিকে দেখান আছে তার মধ্যে ২৭,৬৫ টাকা মাত্র ক্লিয়ার করা হয়েছে। এত টাকা কেন সাসপেন্সে পড়ে থাকবে বুঝলুম না। কিন্তু এর চেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে ইনকাম ট্যাক্স-এর হিসাব আমি এই বিষয়েই বেশি আশঙ্কিত ছিলুম। অন্নদার কাছ থেকে তুমি যে ষ্টেটমেন্টগুলি পাঠিয়েছ তার সঙ্গে দু-এক মাস পূর্বে অন্নদা ডিটেলস, আমাকে ইনকাম ট্যাক্স-এর যা হিসাব পাঠিয়েছিলে তার কোন মিল নেই।

আমি ওকে খুব তাগিদ দিয়ে গত পাঁচ বছরের ইনকাম ট্যাক্স পেমেন্ট-এর একটি হিসাব আদায় করেছিলুম। এই দুটি ষ্টেটমেন্ট অনুযায়ী আমি একটি কম্পারেটিভ ষ্টেটমেন্ট প্রস্তুত করে তোমার কাছে পাঠিয়েছি। মনে রেখো ১৩৫৮ সালের পূর্বে ইনকাম ট্যাক্স যা দেয় তা সম্পূর্ণ শোধ করা হয়েছে। পূর্বেকার দরুন ১৩৫৮ সালে কোন টাকা ডিউ ছিল না।

‘আমার ষ্টেটমেন্ট দেখলে বুঝতে পারবে অন্নদা আমাকে জানিয়েছিল এই তিন বছরে মাত্র ৫৯৮৮০৯ সর্বসমেত ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে, তারপর ১৩৬১ সালে সৌরীন ১৯০০০- দিয়েছে (এটা অন্নদার হিসাবে দেখান নেই অন্নদা হিসাব পায়নি), তাহলে হালনাগাদ ৭৮৮৮০/= দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তোমাকে অন্নদা যে ষ্টেটমেন্ট দিয়েছে তাতে দেখেছি সৌরীনের দেওয়া ১৯০০০/= ধরলে সর্বসমেত ১,২১,৩৩৪/= পেমেন্ট হয়েছে। এই অসামঞ্জস্য কী করে হয়? ৪২,০০০/= টাকার উপর ডিজওভার পেমেন্ট আর একটা বিষয় লক্ষ করা আছে—ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ ১৩৫৮ থেকে ১৩৬১ পর্যন্ত ৪ বছরে টোটাল এমাউন্ট করল ১,০৬,৬৪৭/= অথচ পেমেন্ট করা হল ১২১,৩০৪/= এবং এখনো শুনছি অনেক বাকি আছে দিতে। এরও রহস্য বুঝলুম না।

সমস্ত হিসাব পরীক্ষা করতে সময় লাগবে। কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স পেমেন্ট সমন্ধে এমন একটা গোলমাল দেখছি এ বিষয়ে অনুসন্ধান ফেলে রাখা যায় না। পরীক্ষা করতে ২/১ দিনের বেশি সময় লাগতে পারে না। তুমি পতিসর যাবার আগে এই বিষয়টা অনুসন্ধান ও হিসাব পরীক্ষা করে দেখে তোমার রিপোর্ট আমাকে দিয়ে যাবে। তোমরা এত চেষ্টা করে টাকা দিয়ে যাচ্ছ অথচ ওভার পেমেন্ট হয়ে যাচ্ছে এর বিহিত ব্যবস্থা এখুনি করা দরকার। Saspease clear করার জন্য আমি অন্নদাকে আজ লিখে দিয়েছি। পু: সৌরীন কি এখন কলকাতায় আছে? শান্তিনিকেতনে যাবার আগে আমাদের উকিল বাবুর সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় দেখা করে যেতে পার। তার হাত দিয়ে অধিকাংশ পেমেন্ট হয়েছে। তাঁর কাছেও হিসাব থাকতে পারে। যদি দেখ যে হিসাবে বিশেষ গন্ডগোল আছে তবে আমাকে টেলিগ্রাম কর আমি চলে যাব।

ইতি
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’

হিসাব-নিকাশ সংশোধন করতে অনুরোধ করলেও তাতে খুব একটা ফল হয়নি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আগাম ইঙ্গিত যখন রবীন্দ্রনাথের নিকট আত্মীয় এস্টেটের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছেন, তখন সঠিক হিসাব তো দূরের কথা, স্বয়ং জমিদারের আদেশও অমান্য করেছেন! রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর হৃদয়বিদারক অপর এক চিঠিতে বিশ্বস্ত ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে লিখেছেন—

‘শ্রী বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী কল্যাণীয়েষু,
গত তিন বছরের হিসাব পরীক্ষা করার আমি সুযোগ পাই নাই। অন্নদাকে শৈলেশ বাবুকে হিসাবের খাতা ও ভাউচার অডিটের জন্য দিতে লিখিয়াছিলাম—আমার সে আদেশ অগ্রাহ্য করিয়াছে। তুমি পত্রপাঠ শান্তিনিকেতনে গিয়া অন্নদার কাছ থেকে খাতাপত্র নিজের হেফাজতে লইবে এবং সমস্ত বিষয়ই চার্জ বুঝিয়া লইবে। যখন চলিয়া আসিবে অফিস ঘর ভালো করিয়া তালাচাবি দিয়া আসিবে। হিসাব পরীক্ষা হইয়া গেলে আমাকে অডিট রিপোর্ট পাঠাইয়া দিও।

ইতি, শুভার্থী—
শ্রী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর’

অবশ্য ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী তাঁর প্রিয় জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্পিত দায়িত্ব জমিদারি বিলুপ্তি পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন এবং পতিসর এস্টেটের সব হিসাব-নিকাশের কাগজপত্র নিজ হেফাজতে নিয়েই পতিসর ত্যাগ করেছেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির কিছু আগে ঠাকুর পরিবার যখন অর্থনৈতিক ভগ্নদশায় পড়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ঠাকুর পরিবারে ছেলের বিয়ের জন্য দুই হাজার টাকা ধার চেয়ে ম্যানেজারকে চিঠি লিখেছিলেন কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। নিজে অর্থকষ্টে থেকেও শরিকানদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে প্রতিমা দেবী লিখেছেন— ‘কল্যাণীয়েষু,
বীরেন, জোড়াসাঁকোর বাড়ী থেকে অমিতার চিঠি পেলুম। তার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে ইতিপূর্বে তোমাকে বলেছি। বিয়ের খরচের টাকা সংগ্রহের জন্য তারা খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছে। আমাকে বারবার লিখছে। অজীনের সঙ্গে তোমাকে দেখা করবার জন্য বলেছিলুম। তুমি কি দেখা করেছ? না করে থাকলে নিশ্চয় একবার দেখা করে কথাবার্তা বলে নিয়ো। এ সময় তাদের কিছু টাকা দেওয়া বিশেষ দরকার। প্রয়োজনবোধ করলে তুমি দেরাদুনে তোমার বাবু মহাশয়কে লিখে অনুমতি আনিয়ে, অজীনকে কিছু টাকা দেবার ব্যবস্থা যাতে হয় করবে। তাদের এখন বিশেষ অভাব চলছে, এই সময় তাদের কিছু টাকা না দিলে অন্যায় হবে। আমিতা বৌমা লিখেছেন, ইজারার টাকা হিসাবে পেলে, সেই টাকা তাঁরা নিজেদের কাজে লাগাতে পারেন না, শরিকদের মধ্যে হিসাব মত বণ্টন করে দিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব যে জমিদারির হিসাবের আমার নিজস্ব চার্চ্ছ বাবদ যে টাকা পাওনা হয়েছে। হিসাব যদিও আমি পাইনি তবে সম্ভবত দুই হাজারের উপর হবে। তার থেকে যদি দুই হাজার টাকা আমার নামে অজীনদের ধার দাও (আমি যেন ধার দিচ্ছি এইভাবে) ত খুবই খুশী হব। তাতে আমার অসুবিধা হলেও, এদের এ সময় সাহায্য দেওয়া নিতান্তই উচিত বলে মনে করি। অজীনের ছেলের বিয়ে জানুয়ারীতে স্থির হয়েছে, সেই জন্য তুমি যদি ওদের টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা কর ত খুশী হব। বৌমা জানিয়েছেন অন্তত তাঁর তিন বা চার হাজার টাকার দরকার, আমি দুই হাজার তাদের দিতে পারি সেটা তুমি তাঁকে জানিও। এবং জমিদারিতে ফিরে গিয়ে এক হাজার টাকা আন্দাজ তাঁকে পাঠিয়ে দিও যাতে তাঁরা বিয়ের জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারেন। নভেম্বর শেষে টাকাটা পাঠালেই ওঁদের সাহায্য হবে। আশা করি তুমি যথা সাধ্য চেষ্টা করে এ দায় থেকে আমাদের উদ্ধার করবে।

ইতি
আশীর্বাদিকা, প্রতিমা দেবী’

দুঃখের বিষয়, আজ যখন ‘গীতাঞ্জলি’র ১০০ বছর পেরিয়ে পালন করেছি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী; পালন করছি কবির নোবেল প্রাপ্তির শততম বছর, তখন রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী, অভিভাষণ, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠিগুলোর কিছু অংশ পোকায় কেটে ফেলেছে। বিনষ্ট হচ্ছে সমমানের আরও কিছু নিদর্শন। সংরক্ষণের অভাবে এই মহামূল্যবান রবীন্দ্রস্মৃতি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে তার দায়ভার বহন করবে কে?

তবে আপাতত হাইস্কুলে যে ‘রবীন্দ্র সংগ্রহশালা’ করেছি, তাতে সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে মূল্যবান চিঠিপত্রগুলো প্রদর্শনী করেছি। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, মূল চিঠিপত্রগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? যাহোক, শেষ পর্যন্ত এই মহামূল্যবান নিদর্শন, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রবীন্দ্রনাথ ও পতিসরে দুর্লভ দলিলপত্র সংরক্ষণ করতে পারলেই আমাদের দায়মুক্তি হয়, যা হতে পারে আমাদের শ্রেষ্ঠ কাজও।

লেখক: রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক