নাব্যতা–সংকটে সুরমা নদী ও ভাটির মানুষের কষ্ট

সিলেটের সর্ববৃহৎ নদী সুরমা
ফাইল ছবি

সিলেট নগরীর নিকটবর্তী সুরমা নদীর প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার এলাকা শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে থাকে। তাতে ঘাস গজায়, ছেলেমেয়েরা খেলা করে। দুই কূলের মাঝখান দিয়ে খালের মতো পানি বয়ে চলে। বোঝার কোনো উপায় নেই এটি সুরমা নদীর তীর। অথচ একসময়ের খরস্রোতা নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে খালের মতো রূপ ধারণ করেছে। শুষ্ক মৌসুমে সুরমা নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে পুরো নদীর তীরই এমন মনে হয়। অন্যদিকে বর্ষার শুরুতে নদীটি পানিতে টইটুম্বুর হয়ে থাকে। বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে পানি ফুলে ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে সুরমা নদীর পানি উপচে উঠে সিলেট শহর প্লাবিত হয়। যদিও বন্যার কিছুটা অবনতি হয়েছে। শহরের কোনো কোনো জায়গায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ছিল। যেসব নালা দিয়ে নদীতে পানি প্রবাহিত হয়, সেসব নালা এখনো পানিতে ভরপুর। শহরের বিভিন্ন রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরীর উপশহরের বিদ্যুৎ সাবস্টেশনে পানি ওঠায় বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। ফলে সেসব এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপনে বিঘ্ন ঘটেছে। সবকিছু মিলিয়ে মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করেছে। এ ছাড়া শহরের কয়েকটি এলাকায় এখনো জলাবদ্ধতা দেখা যায়। বিশেষ করে শহরের তালতলা, উপশহর, কাজীর বাজার, তোপখানা, যতরপুর, সোবহানীঘাট, ছড়ার পাড়, মাছিমপুর ইত্যাদি এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।

সুরমা নদীটির নাব্যতা হারিয়ে যাওয়াই বন্যার প্রধান কারণ। সিলেট শহরের ভেতর দিয়ে সুরমা নদী বয়ে চলেছে। ভারতের করিমগঞ্জে বরাক নদীর দুটি শাখা সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। এদের মিলনস্থল সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ এলাকায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রমতে, একসময় বরাক নদী হয়ে আসা পানির ৬০ শতাংশ কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো, বাকি ৪০ শতাংশ পানি সুরমা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু উৎপত্তিস্থল অমলশিদ থেকে ৩৩ কিলোমিটার পর্যন্ত সুরমা নদীর বিভিন্ন স্থানে চর জেগে ওঠায় বর্তমানে ৮০ শতাংশ পানি প্রবাহিত হয় কুশিয়ারা নদী দিয়ে, বাকি ২০ শতাংশ প্রবাহিত হয় সুরমা নদী দিয়ে। মূলত সুরমা নদীতে চর জেগে ওঠায় নদীটি ভরাট হয়ে আসছে। তাই বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল আর ভারী বর্ষণে নদী উপচে নদীর আশপাশের এলাকাসহ সিলেট নগরীর নিচু এলাকা সহজেই প্লাবিত হয়। এ ছাড়া নদীর তলদেশে প্লাস্টিক, আবর্জনা আর পলিথিনে ভরাট হয়ে আছে। তাই শুষ্ক মৌসুমে নদীতে যেমন কম পানি থাকে তেমনি বর্ষাকালে অল্পতেই পানি উপচে পড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মতে, সিলেটে পুকুর-দিঘি মিলে প্রায় তিন শতাধিক জলাশয় ছিল। এর দুই–তৃতীয়াংশ ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া সিলেটের ভেতর দিয়ে ছোট-বড় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল প্রবাহিত হয়েছে, যা ‘ছড়া’ নামে পরিচিত। পাহাড় বা টিলার পাদদেশ থেকে এসব টিলার উৎপত্তি হয়ে সুরমা নদীতে মিশেছে। এসব ছড়া দিয়ে পানিনিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে কয়েকটি ছড়া চোখে পড়লেও এগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা তেমন ভালো নয়। এগুলো সচল রাখারও কোনো উদ্যোগ চোখ পড়ে না। ফলে সামান্য বৃষ্টির ফলে শহরে অতি সহজেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আবার এই দুটি নদীর মধ্য দিয়ে ছোট-বড় প্রায় ১০০টি নদীর পানি প্রবাহিত হয়। তাই এই দুটি নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া মানে প্রবহমান পানিপথে অন্যান্য নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলা।

সর্বশেষ ২০০৪ সালে সারা দেশের মতো সিলেটে বড় ধরনের বন্যা হয়। এবারের বন্যা ও জলাবদ্ধতার জন্য সুরমা নদীর নাব্যতা–সংকটই দায়ী। বিশেষ করে, হাওর অঞ্চলে জলাধার নির্মাণ, নিম্নাঞ্চল ভরাট, পানির স্বাভাবিক গতিপথ বদলে দেওয়া ইত্যাদি। সুরমা নদীর গতিপথে পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ধর্ম অনুযায়ী পাহাড়ি ঢলের শেষ গন্তব্য সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওর। কিন্তু বর্তমান সময়ে বন্যার পানি ভাটির দিকে না নেমে সিলেট শহরের বিভিন্ন জায়গা প্লাবিত হয়। নদীর বাড়তি পানি ধরে না রাখতে পারলে পানির সৃষ্ট বাড়তি চাপে গতিপথ বদলে যায়। তাই সুরমা নদীর পানিও অন্যদিকে প্রবাহিত হয়। যার ফলে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়।

বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় সিলেটের গোয়াইনঘাট, সুনামগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারা বাজার সড়ক, বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে কয়েক শ পুকুরের মাছ। খাল-বিল, নদী-নালা ও হাওরের পানি এখানে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। পানিতে ঢেউয়ের কারণে নদীতীরবর্তী দোকানপাট, রাস্তাঘাট ক্রমেই ধসে যাচ্ছে।

বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি ও মৎস্য চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আকর্ষিক বন্যায় বোরো ধান, আউশের বীজতলা ও গ্রীষ্মকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য খামারিদের প্রায় ২২ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পানি প্লাবিত হওয়ায় অনেকে গৃহস্থালি মালামাল রক্ষায় ব্যস্ত থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে অনেকেই আশ্রয় নিতে পারেনি। তাই গবাদিপশু নিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পানির কারণে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা দুরূহ ব্যাপার। তাই অনেকেই সস্তা দামে এগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। নগর এলাকার অলিগলিতে থাকা ড্রেনের পানি উঠে আসায় স্থানীয়রা বিপাকে পড়েছেন। পানির সঙ্গে উঠে আসছে ময়লা–আবর্জনা, এ ছাড়া দুর্গন্ধের কারণে চলাচলে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে বন্যার পানিতে সড়কে উঠে আসা ময়লা-আবর্জনা পচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। বাসাবাড়ির টিউবওয়েল ও মোটর তলিয়ে যাওয়ায় কাদাযুক্ত পানি আসছে। ফলে খাবার ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারযোগ্য পানির ভোগান্তি রয়ে গেছে।

সুরমা নদীর পানি হ্রাস পেলেও কুশিয়ারা নদীর পানি কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে। বৃষ্টি ও ঢল কমে যাওয়ায় উজানের পানি নেমে ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জে চাপ সৃষ্টি করছে। যেসব এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে, সেসব এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল। বন্যার ময়লা পানি জমে রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পানিবাহিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে। বন্যায় রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাধারণ জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যাকবলিত এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শিশুখাদ্য, শুকনা খাবার, গোখাদ্যের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। প্লাবিত এলাকায় জ্বর, ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিসসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তবে পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত, ক্ষতিগ্রস্ত বাসাবাড়ির তালিকা প্রণয়ন এবং নগরীকে বন্যামুক্ত রাখতে করণীয় নির্ধারণে একটি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডেও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ, তালিকা প্রণয়ন ও করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। এ কমিটির যৌথ প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মে,২০২২)।

টানা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টি হলে সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর খনন ছাড়া সিলেটের বন্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সুরমা নদী পানি ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। খনন হলে পানি ধারণক্ষমতা থাকবে। পার্শ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারের মনু নদ খনন হওয়ায় মৌলভীবাজার শহর বন্যামুক্ত হয়েছে। তাই সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন করলে সিলেট এলাকা বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে। এ দুটি নদী খনন না করলে সিলেট অঞ্চলের সব নদীই একসময় বিপন্ন হয়ে পড়বে। কয়েক বছর পরপর বন্যা দেখা দেবে, ফসলের ক্ষতি হবে, মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।