‘ডলার ইজ আওয়ার কারেন্সি, বাট ইটস ইয়োর প্রবলেম’

ডলার
ছবি: সংগৃহীত

শুরুতেই ঐতিহাসিক দুটি বৈঠকের কথা বলি। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে। বৈঠকটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের শহর ব্রেটনউডসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে বৈঠকটি চলে ২২ জুলাই পর্যন্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিশ্ব অর্থনীতি খুবই নড়বড়ে ছিল এবং মিত্রদেশগুলো মুদ্রা বিনিময়ে জর্জরিত বিরাজমান সমস্যাগুলোর জন্য আলোচনা ও সমাধানের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিল। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন করে আর্থিক ব্যবস্থার রূপরেখা কেমন হবে, মূলত এ নিয়েই বসেছিল বৈঠকটি। একটি টেকসই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি করা, মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন রোধ করা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রচারের প্রধান লক্ষ্য নিয়ে ছিল এই বৈঠক। এই বৈঠকে যে রূপরেখাটি চূড়ান্ত হয়, তার নাম ছিল ব্রেটনউডস ফাইনাল অ্যাক্ট।

ওই সময় বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে ‘পার ভ্যালু’ নিয়ে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমত, প্রতিটি দেশ মার্কিন ডলারের সঙ্গে তাদের পার ভ্যালু বা বিনিময় হার ঘোষণা করবে। দ্বিতীয়ত, ঘোষিত পার ভ্যালুর উভয় পাশে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হারের হেরফের ১ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন ছাড়া পার ভ্যালু পরিবর্তন করা যাবে না। মূলত ১৯৪৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মার্কিন ডলারের বিনিময় হারকেই সব সদস্যদেশ তাদের প্রাথমিক পার ভ্যালু হিসেবে বেছে নেয়।

এ ব্রেটনউডস ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন ডলার এবং পরোক্ষভাবে স্বর্ণকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় সব মুদ্রাই মার্কিন ডলারে রূপান্তরযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। একে বলা হয় স্বর্ণ মানের ব্রেটনউডস সংস্করণ। এই ব্যবস্থায় মুদ্রার অবমূল্যায়নেরও সুযোগ রাখা হলো না।

এল সত্তরের দশক। তখন অর্থনীতিতে সংকট চলছে। ফলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন না করার যে নীতি এত দিন ধরে সবাই অনুসরণ করে আসছিল, তা আর মেনে নিতে পারছিলেন না তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ১৯৭১–এর ১৫ আগস্ট নিক্সন ব্রেটনউডস ব্যবস্থা বাতিল করে দিলেন। ফলে তৈরি হলো নতুন সংকট। নিক্সনের মার্কিন ডলার স্বর্ণে রূপান্তরের ক্ষমতা বাতিল করার এই পদক্ষেপকে বলা হয় ‘নিক্সন শক’।

মূলত নিজেদের বাণিজ্য সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই নিক্সন এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি ডলারের অবমূল্যায়ন করেছিলেন। নিক্সনের এই সিদ্ধান্ত তখন অনেকেই মানতে পারেননি। এর প্রেক্ষাপটেই ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বরের বৈঠকটি বসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে। শিল্পোন্নত ১০টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা বসলেন এই বৈঠকে। ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এই বৈঠকও।

বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল বিনিময় হার ব্যবস্থা নিয়ে একটি সমঝোতায় আসা। এই বৈঠকে নতুন করে সমঝোতা হলেও তা ১৫ মাসের বেশি থাকেনি। পরবর্তী সময়ে যে যার মতো করে বিনিময়ব্যবস্থা অনুসরণ করা শুরু করে, বিশ্ব যাত্রা শুরু করে ফ্লোটিং বা ভাসমান বিনিময় হারের দিকে।

২.
বর্তমানে পৃথিবীতে যত আন্তর্জাতিক লেনদেন হয়, তার বেশির ভাগই হয় এই মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশগুলো যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখে, তারও বড় অংশ রাখা হয় ডলার হিসেবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ২০১৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৬০ শতাংশ রাখা হয় ডলারে।

দ্য ব্যালান্স ডটকমের তথ্যানুসারে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাজার বা ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে যত মুদ্রা বেচকেনা করা হয়, তার ৯০ শতাংশই ডলার। বৈশ্বিক ঋণের ৪০ শতাংশ ইস্যু হয় ডলারে। ডলারের ব্যবহারে বাংলাদেশও অন্যান্য দেশ থেকে ব্যতিক্রম নয়। তাই এর চাঙা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বেশ সমস্যায় পড়েছি।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। চলতি বছরেই পাঁচবার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে টাকাকে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের বিনিময় মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ২৩ মার্চ তা আবার ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছিল। গত ২৭ এপ্রিল বাড়ানো হয় ২৫ পয়সা। তাতে ১ ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। ৯ মে ডলারের বিনিময় মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমিয়েছে। আর সর্বশেষে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ মে আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় হার ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, ২ জুন থেকে তা–ও তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন আবার উন্মুক্ত অর্থনীতির নিয়মে বাজারই মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো যেকোনো দরে ডলার বিক্রি করতে পারবে।

৩.
হঠাৎ করে দেশে ডলারের এ অবস্থা কেন হলো, তাতে একটু আলোকপাত করি। আমাদের দেশে ডলার আসার উৎস হচ্ছে মূলত তিনটি—প্রবাসী আয়, রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ। আর ডলার খরচের অন্যতম দুটো খাত হচ্ছে আমদানি ব্যয় এবং বৈদেশিক দায় পরিশোধ।

কয়েক মাস ধরে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো আয় কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল ও তেলের দাম বেড়ে গেছে। সঙ্গে বেড়েছে জাহাজের ভাড়াও। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। করোনার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আমদানির অনেক এলসির অর্থ পরিশোধ বকেয়া ছিল। এখন সেগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে বাজারের ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্সে সেভাবে ডলারের জোগান বাড়েনি। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

উপরোক্ত পরিস্থিতিতে সাধারণত চাপ গিয়ে পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। কারণ, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আমদানির খরচ জোগান দিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি করেও থাকে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মে পর্যন্ত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫১০ কোটি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। কিন্তু এতে সমস্যাও আছে। কারণ, এর ফলে টান পড়ছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার ছিল রিজার্ভে। এরপর কমতে কমতে তা ৪১ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের আগে রিজার্ভ থেকে ১১-১২ মাসের বৈদেশিক দায় পরিশোধের সক্ষমতা ছিল, এখন তা সাড়ে ৬ মাসের নিচে নেমে এসেছে।
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কম রিজার্ভ থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর তাই বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেকটা এই সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। চাইছে ব্যাংকগুলো বাজার থেকে তার ডলারের চাহিদা পূরণ করুক।

৪.
একটি দেশ মূলত সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি হলে অবমূল্যায়ন করে থাকে। যেমন চীন একবার বাণিজ্যযুদ্ধে জয়ী হতে তার মুদ্রার বড় আকারের অবমূল্যায়ন করেছিল। চীন তখন চেয়েছিল তার রপ্তানি বাড়ুক। রপ্তানিকারকেরা উৎসাহিত হয়ে রপ্তানি বাড়িয়ে দেবেন, তাতে রপ্তানি আয় বাড়বে, তখন লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি কমবে।

বাংলাদেশে এখন চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। আর এতেই কমছে টাকার মান। উল্লেখ্য, সাধারণত যাদের আমদানি কম, রপ্তানি বেশি—তারাই অবমূল্যায়নে বেশি আগ্রহী হন। আবার রপ্তানি কম থাকলেও অবমূল্যায়ন করা যায়। প্রত্যাশা করা হয় যে রপ্তানিকারকেরা উৎপাদন বাড়িয়ে দেবেন। অবশ্য বাংলাদেশের মতো দেশে উৎসাহ পেলেই উৎপাদন বাড়বে, তা সাধারণত দেখা যায় না। এ জন্য অব্যবহৃত উৎপাদনক্ষমতা থাকতে হবে, ভালো বিনিয়োগের পরিবেশের প্রয়োজন হয়। এসব না হলে উৎপাদন বাড়বে না।

৫.
মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমার সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমাদের ডলার দিয়ে তেল কিনতে হয়। ডলারের দাম বেড়ে গেলে তেলের দাম আরও বেড়ে যায়, যার ফল আরও মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানেই একদিকে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়া বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়, তার কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্বর্তী পণ্য। সেগুলোরও দাম বাড়ে। অন্যদিকে এমন কিছু পণ্যও রয়েছে, যেখানে আমদানি খাতে বর্ধিত খরচ তৎক্ষণাৎ দাম বাড়িয়ে ক্রেতার ঘাড়ে চালান করা যায় না। পণ্যমূল্য বাড়লে বিক্রি কমার সম্ভাবনাও যথেষ্ট।

মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকারক। কেননা, এ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। মূল্যস্ফীতি হলে সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। খুব সহজ হিসাবে বলা যায়, আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ হলে সেই একই পণ্য কিনতে হবে ১০৫ টাকায়। কিন্তু ওই বাড়তি ৫ টাকা আয় না বাড়লে ৫ টাকার পণ্য কম কিনতে হবে। ফলে মানুষকে আগের চেয়ে কম ভোগ করতে হয়।

এই মূল্যস্ফীতিকেও আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়—মৃদু মূল্যস্ফীতি ও অতি মূল্যস্ফীতি। মৃদু মূল্যস্ফীতির সময় দাম ধীরে ধীরে বাড়ে। মানুষও তখন আস্তে আস্তে এর সঙ্গে মানিয়ে নেয়, আয় বাড়ায়, উৎপাদকেরা বিনিয়োগ করেন। এতে দেশের উন্নতি হয়। কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে এর সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে, মানুষের জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়ে যায়।

বাংলাদেশে এখন মূল্যস্ফীতি কী হারে বাড়ছে, তা বোঝার জন্য একটু সরকারি তথ্য ঘেটে দেখা যাক। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত মার্চ মাসের মূল্যস্ফীতি ও মজুরির হালনাগাদ তথ্যে বলছে, মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২। অন্যদিকে ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির পেয়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও একই চিত্র ছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩। বিবিএসের হিসাবে, গত মার্চ মাসের আগে দেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে।

এই পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ও প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, এর ভিত্তি বছর ধরা আছে ১৭ বছর আগের, ২০০৫-০৬ সময়ের। ১৭ বছর আগের ভোক্তার আচরণ ধরে ঠিক করা হচ্ছে আজকের মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির সমস্যা হচ্ছে সরকারি হিসাবে যা থাকে, অনুভূত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। হচ্ছেও তা–ই। সাধারণ জনগণের পাতে টান পড়েছে ইতিমধ্যে। আয় দিয়ে আগের মতো জিনিসপত্র কেনা সম্ভব হচ্ছে না সাধারণ মানুষের। রীতিমতো পণ্য ও সেবা কিনতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ, প্রকৃত মজুরি বাড়ছে না। কেননা, মজুরি বা বেতন–ভাতা বাড়লেও তা মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে। এ কারণে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।

উল্লেখ্য, মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম—এ ধরনের ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। তখন করোনার প্রভাবে বহু মানুষ বেকার ছিলেন, অনেকের আয় কমে গিয়েছিল।

৬.
মূল্যবৃদ্ধি কমানোর সাবেক ওষুধ হচ্ছে সুদের হার বাড়ানো ও ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে যে নগদটা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জমা রাখতে হয়, সেটাও বাড়ানো। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে প্রথমটি করেছে। নতুন পলিসি হিসেবে সুদের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো সুদ হার বিদ্যমান বার্ষিক শতকরা ৪ দশমিক ৭৫ ভাগ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে শতকরা ৫ ভাগে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

সুদের হার বাড়লে ব্যাংক থেকে ধারকর্জ নিয়ে বাড়ি-গাড়ি কেনার প্রবণতা কমে, ফলে বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা হ্রাস পায়। ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বাড়লে, মানুষের হাতে নগদের জোগান কমে যায়, ফলে জিনিসপত্রের চাহিদা কমে। আর চাহিদা কমলে জিনিসপত্রের দাম কমার কথা। সমস্যা হলো, সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি চাহিদা বাড়ার জন্য ঘটেনি, অন্য কারণে ঘটেছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওষুধের ফলে চাহিদা কমে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা কমলেও কমতে পারে, কিন্তু উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কমবে সেই সঙ্গে। সেটা অর্থনীতির পক্ষে কি খুব একটা মঙ্গলজনক হবে? তার চেয়ে বরং পণ্য যে মূল্যে আনা হয় আর বাজারে যে মূল্যে থাকা উচিত, সেটি নিশ্চিত করলে মূল্যস্ফীতি হয়তো কমতে পারে।

৭.
শেষ করার আগে একটি উদ্ধতি দিয়ে শেষ করি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময়ে তাঁর প্রশাসনের ট্রেজারি সেক্রেটারি ছিলেন জন কোনালি। তিনি সে সময় ডলার নিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা যখন নিক্সনের ডলারের একতরফা অবমূল্যায়নের প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন সবার মুখের ওপর তিনি বলেছিলেন, ‘ডলার আমাদের মুদ্রা, কিন্তু সমস্যাটা আপনাদের (ডলার ইজ আওয়ার কারেন্সি, বাট ইটস ইয়োর প্রবলেম)।’ উক্তিটি পাঁচ দশক আগের হলেও বিষয়টি আসলে এখনো তা–ই। মুদ্রাটি এখনো আমেরিকার, কিন্তু সমস্যা সবার।

  • লেখক ও কলামিস্ট