খুলল দক্ষিণাদ্বার, আলোকিত পদ্মাপাড়
‘খুলে গেল দক্ষিণাদ্বার
আলোকিত পদ্মাপাড়
পুলকিত জাতির সত্তাসার
পদ্মা সেতু মোদের অহংকার
আমরাও পারি সব উঁচু রেখে শির
বিশ্ব দেখুক আজ আমরাও বীর।’
কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে লালিত দীর্ঘদিনের স্বপ্নটির চূড়ান্ত পূর্ণতা পেতে চলেছে ২৫ জুন। এই দিনে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন উন্নয়নের রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দিনটি বাঙালিদের কাছে এক চরম আনন্দের দিন, পরম প্রাপ্তির দিন। অন্যভাবে বলা যায়, একটি বিজয়ের দিন। যে বিজয় আমাদের অর্থনৈতিক বিজয়, যে বিজয় আমাদের সক্ষমতার বিজয়। এটিকে আমরা বড় বিজয় বলতে পারি, কেননা পদ্মা সেতুর মতো একটি দুঃসাহসিক অভিযানের সফল সমাপ্তি ২৫ জুন ঘটতে চলেছে। পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় অর্জন, এটি আমাদের সক্ষমতার স্বাক্ষর বহন করে। আর এই জাতীয় অর্জনটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য সাহসিকতা, প্রজ্ঞা আর দায়বদ্ধতার কারণে।
পদ্মা সেতু যে আমাদের এক মহা অর্জন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু জাতীয় সংসদে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং একটি তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করেছেন। তিনি কিছু তথ্যউপাত্ত দিয়ে তাঁর বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি সেটা করতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারী দলের উচিত ছিল আরও বেশি তথ্যউপাত্ত দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ কেন ৩০ হাজার কোটি টাকা হলো, সেটা ব্যাখ্যা করা। এতে জনগণ পুরো বিষয়টি জানতে পারত এবং রুমিন ফারহানার অভিযোগ কতটুকু সত্য, তা বুঝতে পারত। রুমিন ফারহানা পদ্মা সেতুকে একটি উদাহরণের মাধ্যমে ‘গোল্ডেন ব্রিজ’ বলতে চেয়েছেন। অধিক খরচ হয়েছে বলে এটাকে তিনি গোল্ডেন ব্রিজ বলেছেন। সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি এটাকে স্বর্ণ সেতু বলেছেন।
আমরা তো মনে করি, এটা আসলেই একটি স্বর্ণ সেতু, তবে সেটা রুমিন ফারহানার ব্যাখ্যার মতো নয়। জনগণের কাছে এ সেতুটি একটি স্বর্ণের খনির মতো। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি যে একটি দামি স্বর্ণের টুকরা। তিনি আরও দাবি করেছেন যে পদ্মা সেতু ‘দুর্নীতির টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হয়ে থাকবে। তবে তিনি তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে জোরালো কোনো ডেটা বা যুক্তি দিতে পারেননি। তিনি ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর উদাহরণ দিয়ে পদ্মা সেতুর অতিরিক্ত ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ৯ কিলোমিটার ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি রুপি অথচ পদ্মা সেতুতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। তিনি শুধু তুলনা দিয়েই তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন।
কিন্তু ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে পদ্মা সেতুর নির্মাণশৈলীর যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে, তা তিনি তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করেননি। ভূপেন হাজারিকা সেতুর নির্মাণ শুরু হয় ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে এবং নির্মাণ শেষ হয় ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। আমাদের পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হচ্ছে ২০২২ সালে। তার মানে ভূপেন হাজারিকা থেকে ৫ বছর পর আমাদের পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হলো। এই ৫ বছরে নির্মাণ ব্যয় কত বেড়েছে, শ্রমিকের মজুরি কত বেড়েছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম কত বেড়েছে, তা রুমিন ফারহানা এড়িয়ে গেছেন। ভূপেন হাজারিকা সেতুর দৈর্ঘ্য পদ্মা সেতুর থেকে বেশি, কিন্তু পদ্মা সেতুর অবকাঠামোগত জটিলতা ভূপেন হাজারিকার চেয়ে বহুগুণে বেশি। উত্তাল স্রোত, নদীর গভীর তলদেশ, বহু গভীরে পাথরের স্তর থাকা, বৈরী আবহাওয়া এবং প্রমত্তা নদীর অস্বাভাবিক আচরণ পদ্মা সেতুর নির্মাণকে জটিল করে তুলেছিল। আর সেই জটিলতাকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে খরচ তো বাড়ার কথাই।
আমাদের পদ্মা সেতুর রূপ কতটা ভয়ংকর, তা তো সেই পরিচিত গানেই তুলে ধরা হয়েছে— ‘পদ্মা রে তোর তুফান দেইখা পরান কাঁপে ডরে, ফেইলা আমায় মারিস না তোর সর্বনাশা ঝড়ে’। যাহোক দুটি সেতুর পাইলিং চিত্র দেখলেই খরচ কেন বেশি হয়েছে, তা বোঝা যায়। ভূপেন হাজারিকার পাইল লোড যেখানে ৬০ টন, আমাদের পদ্মা সেতুর পাইল লোড সেখানে ৮ হাজার ২০০ টন। বিশ্বের আর কোনো সেতুতে নদীর এত গভীরে পাইল করতে হয়নি, যেটা পদ্মা সেতুতে করতে হয়েছে। ভূপেন হাজারিকা সেতুটি দুই লেনবিশিষ্ট কিন্তু আমাদের পদ্মা সেতুটি দ্বিতল সেতুর নিচের অংশে চলবে ট্রেন আর ওপরে অন্যান্য যানবাহন। পদ্মা নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। আর এটাকে চ্যালেঞ্জ করে নদীর তলদেশের ১২২ মিটার গভীরে পাইল নিয়ে যাওয়া কি সহজ কোনো ব্যাপার? এর জন্য কি নির্মাণ ব্যয় বাড়ে না? পদ্মা নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে মিলেছে পাথরের স্তর। কিন্তু ভূপেন হাজারিকা সেতুর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। পদ্মা সেতুর পাইল অধিক গভীরে নেওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোলিক হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো সেতুতে করা হয়নি। এর ফলে কি খরচ বহু গুণে বেড়ে যাওয়ার কথা নয়? পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত পাথরের প্রতিটির ওজন ১ টন, যা অন্য সেতুতে কল্পনাও করা যায় না। ৩৮৩ ফুট গভীরে পাইল লোড করতে হয়েছে এবং এই পাইলগুলোর ওপরে ৫০ হাজার টনের প্রতিটি পিলার দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ভূপেন হাজারিকা সেতুর প্রতিটি পিলার মাত্র ২০ টনের। তাই শুধু তুলনা করলেই হবে না, বাস্তবতার নিরিখে কথা বলা প্রয়োজন। পদ্মা সেতুর মতো এমন স্রোতস্বিনী নদীতে বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী ১০০ বছরে সেতু এলাকায় ২৬ শতাংশ বৃষ্টি বাড়বে। এতে সেখানে পানির প্রবাহ ১৬ শতাংশ বাড়বে। বাড়তি পানির চাপ মাথায় রেখেই সেতুর নকশা করা হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ কিউবেক পানি প্রবাহিত হবে।
যাহোক, আমি কোনো প্রকৌশলী নই, তাই বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমার জন্য অসম্ভব। বাংলাদেশের সক্ষমতা কতটুকু, তা বিশ্ববাসী ভালোভাবেই জানার সুযোগ পেল, এ পদ্মা সেতু নির্মাণে। নির্মাণ ব্যয় নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো যে সেতুর নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে এবং ২৬ জুন থেকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সেতুটির সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজনীতি সম্পর্কিত। সেতুটি নির্মাণ করা ছিল সরকারের একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার বদ্ধপরিকর ছিল। সেতুটি খুলে দেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে দেশের অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে। কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। রাজধানীতে দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য পরিবহনে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সৃষ্টি হবে। কৃষকেরা পণ্যের ভালো মূল্য পাবেন। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি অংশে পরিণত হতে পারে এই পদ্মা সেতু। যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হবে। সেতুটিকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে উঁকি দিচ্ছে সম্ভাবনার পর্যটন। বর্তমানে শুক্র ও শনিবার সেতু এলাকায় দর্শনার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি থাকে। সপ্তাহের অন্যান্য দিনেও প্রচুর ভিড় থাকে। উদ্বোধনের পর পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে। ঘুরে দাঁড়াবে পর্যটন খাত এবং দেশের অর্থনীতি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ট্যুর এজেন্সি সেতু এলাকায় ইলিশ ভোজসহ এক দিনের প্যাকেজ ট্যুর ঘোষণা করেছে। দ্রুত সময়ে ঢাকা থেকে যাওয়া যাবে সুন্দরবন ও সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলে গড়ে উঠবে নতুন নতুন পর্যটন স্থাপনা। এসব পর্যটনকেন্দ্রে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার নামে না হলেও মানুষ যুগের পর যুগ ধরে জানবে এই সেতু শেখ হাসিনার কারণেই সম্ভব হয়েছে। প্রথম বছরে সেতু থেকে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে পৌনে ৫০০ কোটি টাকা। প্রাথমিক অবস্থায় ৮ হাজার যানবাহন প্রতিদিন চলাচল করবে। ২০২৫ সালে ৪১ হাজার প্রতিদিন ৪১ হাজার যানবাহন চলবে সেতু দিয়ে। তিন বছরের মধ্যে সেতুর উভয় পাশে নতুন শিল্পাঞ্চল হবে এবং নতুন নতুন বাস রুট তৈরি হবে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সরকার বছরে গড়ে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা আয় করছে। দিনে ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। পদ্মা সেতু দেশকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে এই সেতু অনন্য ভূমিকা রাখবে। এই সেতুর সবচেয়ে বড় সুফলভোগী হবে সাধারণ জনগণ। পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি শুধু দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে পরিণত হবে। নিজেদের শির উঁচু রেখেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব এবং মূর্ত। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের অলংকার, আমাদের গর্ব। কাব্যিক ভাষায় বলতে হয়---
প্রমত্তা পদ্মার নীল জলরাশি
সেই জলে সেতুটি ফুটিয়েছে হাসি
সেতুতে চড়িবে লাল নীল গাড়ি
সেই সঙ্গে স্বপ্ন চলে যাবে বাড়ি।
*লেখক, সহকারী অধ্যাপক, বিএএফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাস