কুমিল্লা সিটি নির্বাচন-মেয়র প্রার্থীদের সমীপে কিছু জিজ্ঞাসা

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার জন্য আপনাদের জানাই অভিনন্দন। নগরবাসীকে সেবা করার জন্য যে আশার বাণী (প্রতিশ্রুতি) প্রচার করছেন, তাতে আমরা আনন্দিত। নির্বাচনী প্রচারণায় আপনারা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন—জলাবদ্ধতা দূর হবে, যানজট নিরসন করবেন, আধুনিক নগরী গড়ে তুলবেন ইত্যাদি। কিন্তু কীভাবে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন, তা কেউই খোলাসা করে বলেননি। বিগত দুটি নির্বাচনে আমরা একই প্রতিশ্রুতি শুনেছিলাম। গৎবাঁধা কিছু বক্তব্য ছাড়া এবারের প্রতিশ্রুতিতেও নতুন কিছু নেই। নগরের সচেতন নাগরিক হিসেবে কিছু প্রস্তাব ও উদ্বেগের বিষয় আপনাদের সমীপে পেশ করছি। আশা করছি, এসব বিষয়ে আপনাদের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা কুমিল্লাবাসীর কাছে তুলে ধরবেন।

প্রথম বিষয়টি সিটির সীমানা নিয়ে। সিটি করপোরেশনের ভৌগোলিক সীমারেখা অতি অদ্ভুত। শহরের পাশে অবস্থিত হয়েও অনেক এলাকা সিটির বাইরে, আবার মূল শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত (চারদিকে ধানখেত পরিবেষ্টিত) গ্রামীণ লোকালয় সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত। সদর উপজেলা অফিসের গা ঘেঁষে অবস্থিত কুচাইতলী এলাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে। মূল শহরের পাশে হয়েও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাখরাবাদ গ্যাস অফিস, ভিক্টোরিয়া কলেজের ডিগ্রি শাখা, চানপুর, গয়ামবাগিচা, বারাপারা—এসব এলাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ড যেটিকে কুমিল্লার প্রবেশদ্বার বলা হয়, সেটিও সিটির বাইরে। অথচ শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হয়েও চৌয়ারা, দয়াপুর, কমলাপুর, শ্রী বল্লভপুর, চাঙ্গিনী, কোটবাড়ী সিটি করপোরেশনের মধ্যে পড়েছে। কিসের ভিত্তিতে এ সীমানা নির্ধারিত হলো, তা বোধগম্য নয়। সম্মানিত মেয়র প্রার্থীরা, অদ্ভুত এই সীমানা সংশোধনে নির্বাচনী ইশতেহারে আপনাদের কোনো প্রতিশ্রুতি আছে কি?

দ্বিতীয় উদ্বেগ শহরের সম্প্রসারণ নিয়ে। ইতিমধ্যেই আমরা মূল শহরকে ইট–সিমেন্টের বস্তি বানিয়ে ফেলেছি। স্বাধীন দেশে কুমিল্লাবাসী এতটাই স্বাধীনতা ভোগ করেছে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তাও করেনি। স্বার্থপর হয়ে যে যার মতো করে বাড়ি বানিয়েছে। রাস্তা ও ড্রেনের কথা চিন্তাও করেনি। সিটি করপোরেশনের ভূমিকাও নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতো। কর্তাব্যক্তিদের আশ্রয়প্রশ্রয়ে রাস্তা ও ড্রেনের জায়গা নষ্ট করে, মূল সড়কগুলোর গা ঘেঁষে একের পর এক বহুতল ভবন উঠল, আর সিটি করপোরেশন কিছুই করল না। বহুতল ভবন ভেঙে এখন রাস্তা-ড্রেন করা একপ্রকার দুঃসাধ্যই বলা চলে। যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। সামনে সিটি করপোরেশনকে আইনের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। শহরের দক্ষিণ দিকে এখনো সেভাবে অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সেদিকে যাতে কোনো প্রকার নৈরাজ্য না হয়, যে দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে।
কুমিল্লা শহরের উত্তরে গোমতী নদী। যেহেতু পর্যাপ্ত সেতু নেই, তাই উত্তরে শহর সম্প্রসারণের সুযোগ কম। পূর্ব দিকে কয়েক মাইল পরে ভারত সীমান্ত। নিরাপত্তাজনিত কারণে সেদিকে সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। পশ্চিম দিকে খোলা জায়গা থাকলেও, তা সিটি করপোরেশনের বাইরে। বাকি আছে শুধু দক্ষিণ দিক। ধানখেত আর গ্রামীণ লোকালয় হলেও সিটি করপোরেশন দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত হবে, এটা সহজেই অনুমেয়। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও প্রশস্ত রাস্তাই এর মূল কারণ। ইতিমধ্যে দক্ষিণ দিকে দ্রুত নগরায়ণ দৃশ্যমান। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে যার মতো বাড়ি করা শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে খোলা ধানখেতে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে স্থাপনা উঠে যাবে। তাই সময় থাকতে এখনই দক্ষিণ দিকের পরিকল্পনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিতে হবে। রাস্তা ও ড্রেনের ব্যবস্থা আগে করতে হবে, তা না হলে ঢাকা চট্টগ্রাম থেকেও ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে।

তৃতীয় উদ্বেগ যানজট নিয়ে। যানজট এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। কিছুদিন আগেও যানজট ছিল সহনীয় পর্যায়ে। এখন এর কোনো ব্যাকরণ নেই। শহরের ভেতর একটি বাস ঢুকলে যে যানজট হয়, তার রেশ রাত আটটা পর্যন্ত থাকে। প্রাইভেট কার চালিয়েও খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন না, চারদিকে শুধু রিকশা আর রিকশা। রিকশার কারণে রাস্তা পার হওয়া যায় না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অনুমোদনহীন অটোরিকশার উৎপাত। টমছম ব্রিজে গেলে বোঝা যায় যানজট কী জিনিস। পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড দিয়ে নতুন কেউ শহরে ঢুকলে কুমিল্লা সম্পর্কে প্রথমেই তাঁর নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হবে। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে এখানে প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। তারা আদৌ কোনো কিছু করছে কি না, না বিধাতার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে? তা আসলেই ভাবনার বিষয়। শাসনগাছা ফ্লাইওভার ইতিমধ্যেই গলার কাঁটা হয়ে হাজির হয়েছে—না গিলতে পারছি, না পারছি ফেলতে। এই ফ্লাইওভার করার আগে কোনো সমীক্ষা হয়েছে কি না অথবা স্থানীয় জনগণের মতামত নেওয়া হয়েছে কি না, সেটা নিয়ে সংশয় আছে। এ অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। যখন সিটি করপোরেশন যাত্রা শুরু করেছিল, তখন রাস্তা প্রশস্ত করার সুযোগ ছিল। এখন সেই সুযোগ কম। তারপরও যানজট নিরসনে মেয়র প্রার্থীদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা কুমিল্লাবাসী জানতে চায়।

চতুর্থ উদ্বেগের বিষয় জলাবদ্ধতা। শহরের কিছু পয়েন্টে স্বাভাবিক সময়েও রাস্তায় পানি উঠে যায়, বাসার ভেতরে পানি ঢুকে যায়। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এ সমস্যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হবে, তা সহজেই অনুমেয়। তবে এটি এখনো সমাধান করার মতো অবস্থায় আছে। পুরো শহরের পানি কয়েকটি মূল খাল দিয়ে তিন দিকের (উত্তর দিক বাদে) খোলা জায়গায় চলে যায়। বেশির ভাগ পানি প্রবাহিত হয় দক্ষিণ দিক দিয়ে। এর মধ্যে টমছম ব্রিজের পাশ দিয়ে প্রবাহিত খাল, ইপিজেডের সীমানা ঘেঁষে প্রবাহিত খাল, কুচাইতলীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত খাল অন্যতম। এর সব কটিই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত। এই তিনটি খালের পানি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পড়বে, তা সিটি করপোরেশনকে নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, এখন খোলা জায়গা থাকলেও কিছুদিন পর এ জায়গাগুলো পতিত থাকবে না, ভরাট হয়ে ঘরবাড়ি উঠে যাবে। ইপিজেডের মধ্য দিয়ে যে খাল গেছে, তার কোনো শেষ গন্তব্য নেই। ইপিজেড পার হয়ে পরের গ্রামের লোকালয়ের পাশে ধানখেতে এই পানি যাচ্ছে। ফলে ইপিজেডের বিষাক্ত বর্জ্যে এ অঞ্চলের মানুষ অতিষ্ঠ। সিটি করপোরেশনের পরিবেশ বিভাগ এখানে নখদন্তহীন। নিয়ম অনুযায়ী এই পানি পরিশোধিত হয়ে খালে আসার কথা, কিন্তু কোম্পানির মালিকেরা তা মানছেন না। এ ছাড়া এ পানি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পড়বে, সেটিও সুরাহা হওয়া দরকার।
পঞ্চম উদ্বেগ নগরীর বাসযোগ্যতা নিয়ে। নগরীর বাসিন্দাদের মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখার জন্য প্রয়োজন পার্ক, খেলার মাঠ ও পর্যাপ্ত খোলা জায়গা। তার পাশাপাশি সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। সুকুমার বৃত্তি ও চিত্তকে উন্নত করার জন্য প্রয়োজন লাইব্রেরি ও সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো কার্যক্রম সিটি করপোরেশন দেখাতে পারেনি অথবা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মনের বাড়ির আঙিনা এখন নেশাখোরদের আস্তানা, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, ড. আখতার হামিদ খানের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো আজ অবহেলিত। আমাদের অধঃপতন এতটাই হয়েছে যে বিখ্যাত এই মানুষদেরও আমরা উপযুক্ত সম্মান দিতে শিখিনি।
কুমিল্লাকে একসময় বলা হতো ব্যাংক ও ট্যাংকের নগরী। শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে অসংখ্য দিঘি, পুকুর, জলাশয় দেখতে পাওয়া যায়। একটি পুকুর বা দিঘি শেষ হওয়ার অল্প দূরত্বেই আরেকটি দিঘি বা পুকুর। একসময় পুকুরের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। জলাশয় ভরাট হয়ে লোকালয় ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমছে। অথচ একটি শহরকে বাসযোগ্য রাখার জন্য জলাশয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো শহরে দূষণের কারণে যে ধুলাবালু বাতাসে ওড়ে, তার বেশির ভাগ জলাশয়ের পানি শোষণ করে নেয়। এ ছাড়া এটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, নগরীকে স্বাস্থ্যকর রাখে।

আমাদের শেষ প্রশ্ন মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে। মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে কুমিল্লাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে—এই প্রতিশ্রুতি বিগত সব নির্বাচনে সব প্রার্থীই দিয়েছেন। এ নির্বাচনেও মাস্টারপ্ল্যানের প্রতিশ্রুতি আমরা শুনতে পাচ্ছি। আদৌ কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে কি না, থাকলে সেটা কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তা আমাদের জানতে ইচ্ছা করে। মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া উন্নয়নকাজে হাত দিলে তা একসময় গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দেবে। শহরের পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে, বাড়ছে বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও অফিস। ইদানীং গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, মেঘনা নামের নতুন বিভাগ হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন বিভাগের কাজ পরিচালনার জন্য নতুন অবকাঠামো, বাড়তি জনবল ইত্যাদির প্রয়োজন হবে। জনসমাগম বাড়বে। বাড়তি বর্জ্য উৎপন্ন হবে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির চাহিদা, স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। রাস্তা ও ড্রেন প্রশস্ত করার প্রয়োজন হবে।
সম্মানিত মেয়র প্রার্থীরা, বাড়তি এ চাপ সামলানোর জন্য আপনাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি, নাগরিক হিসেবে আমরা জানতে চাই।

  • লেখক: শ্যামল আতিক, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের একজন বাসিন্দা