কর্মঘণ্টা নষ্ট ও আমাদের হারা-জেতা
বিরাট মসিবতের মধ্যে পড়ে গেছি। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় শুক্র-শনিবারও ক্লাস করতে হয় এখন। দিনাজপুর থেকে রংপুরের দূরত্বের কথা চিন্তা করলে সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে আসার লোভ সামলাতে পারি না। বাড়ির কাছাকাছি কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার এটা কোনো সুবিধা নাকি অসুবিধা—এটা ভালো প্রশ্ন হতে পারে। তবে বাড়ি আসার মতো কোনো উপলক্ষ পেলে বাড়ি আসতে ভালোই লাগে, ব্যাপারটা খারাপ লাগার মতো নয়।
তো এই সপ্তাহে শুক্র-শনিবারে যেহেতু ক্লাস হচ্ছে না, তো এই অবকাশে বাড়ি থেকে ঘুরে এলে খারাপ হয় না। আমি যদিও প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই না বা যাওয়ার অতটা ইচ্ছা থাকে না সাপ্তাহিক ছুটিতে। তবে আমি এবার বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি, শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিতেও ক্লাস চালু থাকায় প্রতি সপ্তাহে মনে হয়—এ সপ্তাহে বাড়িতে যেতে পারলে ভালো লাগত। মাঝেমধ্যে ৫-১০ সেকেন্ডের জন্য দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যেত, বাড়ি আসার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে থাকত, কিন্তু সুযোগ নেই। যখন সুযোগ থাকে, তখন আবার এই উপলব্ধিটা কাজ করে না। মানুষের এ ধরনের মানসিক অবস্থার ব্যাখ্যা কী, আমি আসলে বুঝতে পারি না। তবে ভাবি—অবশ্যই এ ব্যাপারে কোনো না কোনো ব্যাখ্যা তো আছেই।
যাই হোক, আজ (গতকাল বুধবার) ক্লাস শেষ করে জানতে পারলাম কাল বৃহস্পতিবার ক্লাস হবে না। কলেজের বন্ধু সজীবের সঙ্গে কথা বলে ঝটপট সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকেই বাড়ি যাব আমরা। কিন্তু আমার আবার চিন্তা ছিল কাল ধীরে সুস্থে বেলা ১১টার ট্রেন ধরে বাড়ি যাওয়া। কিন্তু তা আর হলো না। সিদ্ধান্ত হলো আজ বেলা দেড়টায় বিআরটিসি বাস আছে, সেই বাসে করে রংপুর যাব। প্রাথমিকভাবে সজীব প্রস্তাব করেছিল, বেলা আড়াইটার দিকে একটা ট্রেন আছে। যে ট্রেনে করে আমরা সর্বোচ্চ পার্বতীপুর পর্যন্ত যেতে পারব এবং সেখান থেকে বাসযোগে ৫০ টাকার ভাড়ায় একেবারে রংপুর। কিন্তু আমি তাঁর প্রস্তাবে দ্বিমত করে বিআরটিসি বাসে যাওয়ার প্রস্তাব করি এবং বলি—‘তোর ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে যদি পার্বতীপুর থেকে বাসে করে আবার রংপুর যেতে হয়, তো আমি তোকে হাফ ভাড়াতে (৬০ টাকা) রংপুর নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব।’ সে আমার কথায় ভরসা না পেলে আমি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলি, ‘তুই আমাকে ৬০ টাকা দিস, আমি তোকে রংপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিব। এর বেশি যদি কোনো টাকা লাগে, তার ভার আমি বহন করব।’ সে এই কথা শুনে আমার প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করে এবং আমরা ক্লাস শেষে মেসে গিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে বেলা দেড়টার বাস ধরার জন্য চলে আসি।
এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। লোকাল, গেটলক, হলুদ-সাদা পতাকাবাহী বাস যায়-আসে, কিন্তু বিআরটিসি বাসের খবর নেই। আমাদের সঙ্গে দুজন বান্ধবী যেতে চাইলেও তারা বিআরটিসি বাসের অপেক্ষায় থেকে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। তাদের অন্য বাসে যাওয়ার পরামর্শ দিই। তারা চলে গেলেও সজীব আর আমি বাসের অপেক্ষায়। এর মধ্যে কত জুনিয়র সালাম দিয়ে এলো–গেল, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বাস আসে না। বিরক্তি নিয়ে একবার দিনাজপুর ডিপোতে ফোন দিলে তারা বলে, আজ নাকি দেড়টার বাস চলবে না! কী আর করার, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকা মানুষ। বিআরটিসি বাসের জন্য যেহেতু এতক্ষণ অপেক্ষা করেছি, আমরা বিআরটিসি বাসেই যাব। পরের বাস বিকাল তিনটায়। দেড়টার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পরবর্তী বাসের সময় প্রায় হয়েই গিয়েছে। বেলা দেড়টার বাসের জন্য দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে আমরা বিকাল তিনটার বাসে করে রংপুরের উদ্দেশে রওনা হই।
ভাড়া দেওয়ার সময় বাস কন্ডাক্টরকে কিছুটা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে যখন দুজনের ভাড়া ১২০ টাকা দিতে সক্ষম হই, তখন চ্যালেঞ্জে জিতে যাওয়ায় বিজয়ীর বেশে সজীবকে দেখিয়ে হালকা করে কিছুটা উল্লাস প্রকাশ করি। মনে মনে সজীবও নিজেকে বিজয়ী ভাবছে, যতই হোক তাঁর-ও তো কিছু লাভ হলো!
তবে বিজয় উল্লাস শেষে একটা পরিসংখ্যান যখন মাথায় এল, তখন মনে মনে ভাবতে লাগলাম—আমরা কি আসলেই বিজয়ী হয়েছি? বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবমতে, ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যার আর্থিক মূল্য হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। বছর শেষে এই ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা বা তার-ও বেশি। এখন কথা হচ্ছে, আমরা যে হাফ ভাড়া দেওয়ার আশায় দেড় ঘণ্টা ধরে বিআরটিসি বাসের জন্য অপেক্ষা করেছি, এতে আমাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। এর আর্থিক ক্ষতি যদি হাফ ভাড়ার সঙ্গে হিসাব করি, তাহলে কি ফুল ভাড়ার সমান আর্থিক মূল্য হবে? নাকি এর চেয়ে বেশি বা কম আর্থিক মূল্য হবে? এই নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যাই। এই হিসাব কষতে কষতে রংপুরে চলে আসি। এখনো হিসেব কষছি, আসলেই কি জিতলাম, নাকি হারলাম?
লেখক: শাহরিয়ার সিফাত, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected] এ