করোনাকালের গল্প
আমার ফোনটা জন্ম থেকেই বোবা। মেসেজ বা কল এলে শুধু বোবা মানুষের মতো কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বলতে পারে না। এতে অনেক সুবিধা আছে। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে বেজে ওঠে না। কারও বিরক্তির কারণ হয় না। এভাবে যদি মানুষের মুখও বন্ধ করে রাখা যেত, তাহলে পৃথিবীতে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু আফসোস! এ রকম যন্ত্র এখনো আবিষ্কৃত হয়নি!
ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে ওঠে। ফোনটা হাতে নিলাম। একটা মেসেজ এসেছে। আইইডিসিআর থেকে। জীবনে সবকিছুতেই পজিটিভ হতে চেয়েছি। সবকিছুই পজিটিভ আশা করেছি। কিন্তু আজ প্রথমবারের মতো ভিন্ন রকম চাচ্ছি। মনে-প্রাণে চাচ্ছি নেগেটিভ হোক। বুক ধড়ফড় করে। মেসেজ ওপেন করার মতো শক্তি পাই না। হাত-পা কাঁপে। মনের মধ্যে ভয় আর সংশয় কাজ করে। নেগেটিভ আসবে তো?
গত দুই মাস আমি বাড়ির বাইরে বের হইনি বললেই চলে। জরুরি প্রয়োজনে খুব সাবধানে সতর্কতার সঙ্গে বের হয়েছি। প্রয়োজন সেরে দ্রুত চলে এসেছি। সর্বক্ষণ বাড়িতেই থেকেছি। বই পড়েছি, রান্না করেছি, ঘুমিয়েছি। বাড়িতে টুকটাক কাজ করেছি। দুই মাসকে মনে হয়েছে এক যুগ।
বাড়ির সবাইকে সাবধান করে দিয়েছি। সবাই সাবধানে থাকার চেষ্টা করেছে। বাড়িতে থেকে হাঁসফাঁস করেছে। ছোট ভাই ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুল বন্ধ। সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকে। আমাকে কাজে টুকটাক সাহায্য করে। বাড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু আমার ভয়ে কোথাও যায় না। ছোট বোন শ্বশুরবাড়িতে আছে। অনেক দিন হলো যাওয়া হয় না। ফোন করে। ফোন ধরি— হ্যালো! কেমন আছিস? ভালো আছি। অনেক দিন হলো তুমি আসো না। একবার আসো? আমাকে দেখে যাও। এই সময়ে কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। সবকিছু ঠিক হোক। পরে যাবোনে। ক্যান? কত মানুষই তো যাচ্ছে! তুমি আসলে সমস্যা কী? তাদের তো কিছু হয় না! শুধু তোমারই অসুখ হবে? আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারি না। ছোট বোন রাগ করে। ফোন কেটে দেয়। মামা ফোন করে। রিসিভ করি— আসসালামু আলাইকুম। ওয়ালাইকুম আসসালাম। মামু কেমন আছ? ভালো আছি মামা। তুমি কেমন আছ? আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ম্যালাদিন ধইরা তো আমগোর বাড়িত আইয়ো না, অহন তো বাড়িতই আছো। বেড়াইয়া যাও। মামা, দেশের অবস্থা তো এখন ভালো না। ভালো হলে যাবোনে। দুরু ব্যাডা! এসব কিচ্চু না। হায়াত থাকতে কেউ মরবো না। হায়াত শেষ অইয়া গেলে ঘরে বইয়া থাকলেও বাচুন যাইতো না। আমি মামাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। মামাও বুঝতে পারে। আমার সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। তাই আর কথা বাড়ায় না। ফোন রেখে দেয়। বুঝতে পারি রেগে গেছেন। খালা মারা গেছেন ৪০ দিন হলো। আত্মার মাগফিরাতের জন্য চল্লিশা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খালু আমাকে যেতে বলেছেন। অন্তত ৫০ জন লোক তো হবেই। এই অসময়ে এসব ঠিক হবে না। আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ওনাদের বোঝানো যাবে না। একটা অজুহাত দেখিয়ে আমি যাইনি। জানতাম অজুহাতে কাজ হবে না। হলোও তাই। খালু রাগ করেছেন। আমরা কোথাও যাচ্ছি না। কিন্তু বাড়িতে হুটহাট আত্মীয়স্বজন এসে ওঠে। তাদের কিছুতেই বোঝানো যায় না। এখন বেড়ানোর সময় নয়! কিছু বললেই রেগে যান। আবোল-তাবোল বকেন। বেশি শিক্ষিত হয়ে গেছি। বড় চাকরি পেয়ে গেছি। তাই এখন আর আত্মীয়দের চিনি না। বাড়িতেও আসতে দিতে চাই না। ফলে আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হয়!
পাশের বাড়ির একজন সপরিবার নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। ওখানে চাকরি করেন। মা–বাবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে এসেছেন। নারায়ণগঞ্জ এখন বিপজ্জনক এলাকা। করোনার হটস্পট। খবর পেয়ে গ্রামের মেম্বার আসেন। ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। বিকেলেই গ্রামের বাজারে যান চা খেতে। রাত পর্যন্ত আড্ডা দেন। নিষেধ করা সত্ত্বেও ওই বাড়ির অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসেন। কিছু বলতে পারি না। বললেও কানে তোলেন না। সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়। এর কিছুদিন পরেই আমার খারাপ লাগা শুরু হয়। সঙ্গে হালকা জ্বর ও গলাব্যথা। আইইডিসিআরের হেল্পলাইনে ফোন করি। নমুনা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। আজকে রিপোর্ট আসার কথা। জীবনে এই প্রথম নেগেটিভ কিছুর জন্য অপেক্ষা। মেসেজ ওপেন করার সাহস পাই না। পুরো শরীর কাঁপে। হাত থেকে মুঠোফোন পড়ে যায় যায় অবস্থা। কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ ওপেন করি। দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে। কোনো লেখাই দেখতে পাই না। হাত দিয়ে দুচোখ কচলাই। কানের কাছে হিমু হিমু ডাক ভেসে আসে। ঘুম ভেঙে যায়। দেখি হাতে কোনো মুঠোফোন নেই। ড্রয়ার থেকে ফোন বের করি। ফোনে এ ধরনের কোনো মেসেজ নেই। আসার কথাও না। কারণ, আমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ। হাসপাতালেও কোনো নমুনা পাঠায়নি। বুঝতে পারি সব স্বপ্ন ছিল। মধ্যদুপুরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? ঘুম ঘুম চোখে ঘরের বাইরে আসি। দেখি মতি নানা এসেছে। উনিই ডাকছে আমাকে। ডাকার আর সময় পেল না! রিপোর্ট নেগেটিভ না পজিটিভ জানা হলো না! এই ছোট্ট জীবনে কত কিছুই তো অজানা রয়ে যায়। কে তার খবর রাখে? একজীবনে মানুষ কতটুকুই–বা জানতে পারে?
*লেখক: প্রভাষক, সরকারি কলেজ