করোনা কান্নায় বন্যার ধ্বনি

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বিপর্যয় দেশ অনেকটাই কাটিয়ে ওঠার পথে, ঠিক তখনই বন্যার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত জীবন। বিরামহীন বৃষ্টি, উজানে নেমে আসা ঢল—এ দুইয়ে মিলে বন্যার পদধ্বনি এখন সিলেটে। সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্য নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। ফলে আকস্মিক বন্যায় বিপাকে পড়েছেন হাওরাঞ্চলের ভুক্তভোগী মানুষ। প্রায় প্রতিবছর আষাঢ় মাসেই দেশে বন্যার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। প্রথমে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চল ডুবে যেতে দেখা যায়। সেই পানি যেখান দিয়ে নেমে যায়, সেখানেই তীব্র ভাঙন আর প্লাবন দেখা যায়। এরপর দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা দেখা যায়।

পানি যতই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়, সেসব এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। শুধু বর্ষাকালে নয়, আশ্বিন-কার্তিকেও বন্যা হয় এ দেশে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বন্যা হয়েছিল। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বন্যা হয়। কারণ, নদীবাহিত পলি জমে এই বদ্বীপের জন্ম। বন্যায় এই পলি সমতলে ছড়িয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাই বাংলাদেশের জন্য বন্যা একই সঙ্গে অভিশাপ ও আশীর্বাদ। তবে এটা ঠিক, মানুষের পরিবেশবিধ্বংসী নানামুখী কার্যক্রমের কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে।

মূলত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার পানির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারত, নেপাল ও চীন। এসব দেশ থেকে প্রবাহিত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। উজানের দেশগুলো থেকে বয়ে আসা পানির প্রধান নির্গমন পথ হচ্ছে জিএমবি, বেসিনস। অর্থাৎ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বার্ষিক সম্মিলিত প্রবাহের একটিই নির্গমন পথ, অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণক্ষমতা কমতে থাকে। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশে পড়ে। কারণ, বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা—দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায়। একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮ লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বার্ষিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১ লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদীর প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টির কারণে।

প্রতিবছর ছোট-বড় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য নদ-নদীর নাব্যতা বাড়াতে হবে সর্বাগ্রে। আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ড ও অদূরদর্শিতায় একসময়ের খরস্রোতা নদীগুলো আজ জীর্ণশীর্ণ অথবা মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। নদ-নদীকে অবশ্যই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। যেকোনো দুর্যোগে সবার আগে মানবিক বিপর্যয়ের দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এ জন্য বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় অসহায় মানুষ যাতে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় পায়, এ ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। ইতিমধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে।

এতে করে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্যার্তদের উদ্ধারের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।


*মো. মেহেদী হাসান অর্ণব, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা