এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা আমায় ছাড়া

লাশ
প্রতীকী ছবি

‘সুইসাইড ইজ ইনটেনশোনাল টেকিং অব ওয়ান’স ওন লাইফ’। আত্মহত্যা মানে স্বেচ্ছামৃত্যু, নিজেই নিজেকে হত্যা করা। মানুষ কেন নিজেই নিজেকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা জানা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সমাধান ধোঁয়াশা হয়ে থেকে যায়। একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়তো কিছুদিন মানুষকে একটু ভাবায়, আচ্ছন্ন করে রাখে, তারপর সবকিছু সেই আগের মতোই স্বাভাবিক ও চিরন্তন নিয়মে চলতে থাকে। শুধু যে বা যারা হারায়, তারা বয়ে বেড়ায় এ মৃত্যুযন্ত্রণা আর না থাকার কষ্ট।

মানুষ নাকি নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাহলে কেন বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ? এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত সবারই অজানা। বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে একধরনের অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাহলে কি বলব স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা সব বোধ-বিবেচনা লুপ্ত করে দেয়?
আজকাল খবরের কাগজ ও টিভি খুললেই চোখে পড়ে আত্মহত্যার ঘটনা। এ যেন রোজকার খবরের শিরোনাম হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা, মডেলিং—সব জায়গাতেই রোজ ঘটছে এসব অঘটন। কোনো অনিশ্চয়তা, কোনো হতাশা, কোনো শিকলে আটকে যায় জীবন নামক সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যে সেখান থেকে মুক্তি পেতে আশ্রয় নিতে হয় স্বেচ্ছামৃত্যুতে? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, ঠিক কতটা কষ্ট পেলে কতটা অভিমান জমলে কতটা হতাশা গ্রাস করলে এমন নির্মম পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

সকালের শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি, মধ্যদুপুরের একলা থাকা নদীর জল কিংবা বিকেলের নরম আলোয় যদি জীবনের গভীরতা খুঁজি, তাহলে বেঁচে থাকা আনন্দের মনে হয়। ঝুম বৃষ্টিতে আমার একলা শহরে শুধু শূন্যতাকে সারথি করে আমি জীবনকে দেখেছি তাকিয়ে তাকিয়ে। তপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত মানুষের ভিড়ে মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছি নির্লিপ্তভাবে। অগণিত মানুষের শহরে আমার বাস, তবু মধ্যরাতে রানারের মতো ছুটেছি একলা আমি হাসপাতালের লম্বা করিডরে আপনজনের বেঁচে থাকাবার শেষ অপেক্ষায়। এ শহর আমাকে অসংখ্যবার বোকা বানিয়েছে, জমে থাকা শেওলাকে কেবলই সবুজ ভেবে পা ডুবিয়ে হোঁচট খেয়েছি বহুবার। উঠে দাঁড়িয়েছি। হেরে যেতে যেতে মনে হয়েছে, দেখি না কী আছে শেষটায়! জীবন মানেই তো সাসপেন্স, জীবন মানেই তো খেলা। ‘খেলা’ ছবিতে শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্যের সেই গানের মতো...
খেলা খেলা দিয়ে শুরু
খেলতে খেলতে শেষ
কেউ বলেছিল ছি ছি
কেউ বলেছিল বেশ
কেউ বেসেছিল ভালো
কেউ খুঁজেছিল আলো
কেউ আলো খুঁজে পায়নি বলেই
হয়তো নিরুদ্দেশ…।

একজন মানুষ যখন কোনো বিশেষ প্রমাণ না রেখে আত্মহত্যা করে, তখন তাকে নিয়ে আমরা নানা রকম মনগড়া কথা বলি, অবান্তর মন্তব্য করি। একবারও ভেবে দেখি না আমাদের বলা অযাচিত কথা, না জানা মন্তব্য কোনো সমাধান নয়, বরং আরও জটিলতা বাড়ায়। মানসিকভাবে ভেঙে যাওয়া সেই পরিবারের ওপর সামাজিক চাপও সৃষ্টি করে।

তবে আজকাল আত্মহত্যা যেন লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। একটু মন খারাপ হলে, বন্ধুর সঙ্গে অভিমান হলে, মা-বাবা বকলে, শিক্ষকেরা বকলে দুম করে মরে যাচ্ছি। কেন? জীবন তো একটাই এর কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। এটা বোঝার মতো মেধা যাদের সবচেয়ে বেশি, তারা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রজন্ম। অথচ হিসাবের খাতায় তাদের নামটাই যেন বেশি উঠে আসছে। কিন্তু কেন? কিসের এত দুঃখবোধ, কিসের এত না পাওয়া তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের যে এই সুন্দর জীবনই বিসর্জন দিয়ে দিতে হয় চিরতরে? কিসের এত অভিমান নতুন প্রজন্মের? দরিদ্রতা বা না পাওয়া যেমন হতাশায় ভোগায় তেমনি অনেক বেশি প্রাপ্তিও জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন অনেক বেশি ওপেন হয়ে গেছে। ফেসবুক নামক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো মানুষকে একে অন্যকে জানার এবং সবাইকে সবার কাছাকাছি আসার পথটাকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও কি আমরা ভাবতে পারতাম মানুষ মানুষের মুখোমুখি হয়ে জানান দিয়ে আত্মহত্যা করবে, অথবা মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে লিখে যাবে, সে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

একটা সময় তো ফেসবুক ছিল না। লাইভ, স্ট্যাটাস—এসব শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিতও ছিলাম না। প্রযুক্তি আধুনিক হয়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ধ্যানধারণাও বদলে গেছে। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সবকিছু শেয়ার করছে এই ফেসবুক নামক গণমাধ্যমে। শুরুর দিকে মানুষ আনন্দ-উল্লাস আর ভালো লাগাটুকু ভাগাভাগি করলেও এখন জীবনের নেতিবাচক দিকটাও অবলীলায় তুলে আনছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেউ আনন্দ ভাগ করে শান্তি পায়, কেউবা দুঃখ। কিন্তু যারা নিজের মৃত্যুর মুহূর্তটাও সমগ্র পৃথিবীর কাছে সাক্ষী রেখে যাচ্ছে, সেটা যে কী ভয়াবহ ও মর্মান্তিক, তা বলাই বাহুল্য।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতিটি সুইসাইডে রক্তের তিনটি এলিমেন্ট মিশে থাকে।
১. অভিমান
২. হতাশা
৩. আত্মবিশ্বাসের অভাব।
তবে আমি বলব, আত্মহত্যা অপরাধ নয়, এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আর যদি অপরাধই হয়ে থাকে, তাহলে যে কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে, সেটাকে তো আত্মহত্যার প্রবঞ্চক হিসেবে ধরা উচিত। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই আত্মহত্যার পেছনের কারণকে কখনোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। মানুষ কি তাহলে শখের বশে নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করে। মোটেও তা নয়। মানুষ সত্যি অভিমানী প্রাণী। তারপরও বলব, শুধু অভিমান থেকে নয়, জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, যন্ত্রণা, দুঃখ, হতাশা—এসবই বোধ হয় মানুষকে ধীরে ধীরে ঠেলে দেয় স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে।

কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মহত্যা কি কোনো সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হতে পারে? সম্ভবত না। জীবন মানেই সংগ্রাম, জীবন মানেই লড়াই। জীবন মানেই সীমাহীন উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যাওয়া এক বহমান নদী। হেরে যাওয়া বা থেমে যাওয়া কোনো যৌক্তিক কথা নয়। হয়তো লোকে বলবে জীবন সব সময় যুক্তি দিয়ে চলে না। আমিও জানি আবেগহীন মানুষ যন্ত্রের মতো। রাগ-দুঃখ, মান-অভিমান, এসব মিলিয়েই একজন মানুষের জীবন। এসব বাদ দিয়ে মানুষ পরিপূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু সব অভিমান এর গন্তব্য সুইসাইড হতে পারে না।
কী কী কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে, তা আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি।
মানুষ হতাশায় আত্মহত্যা করে।
মানুষ অপমানে আত্মহত্যা করে।
মানুষ দরিদ্রতায় আত্মহত্যা করে।
মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে আত্মহত্যা করে।
মানুষ লজ্জায় আত্মহত্যা করে।
মানুষ প্রতারিত হলে আত্মহত্যা করে।
মানুষ সবচেয়ে কাছের মানুষ দ্বারা কষ্ট পেলে আত্মহত্যা করে।
মানুষ ভীষণ রকম একা হয়ে গেলে আত্মহত্যা করে।

গবেষকেরা বলছেন, আত্মহত্যা একটা রোগ। এমনকি সম্প্রতি যেভাবে প্রতিদিন মানুষ আত্মহত্যা করছে, তাতে অনেক মনোবিদই একে সংক্রামক বলেও ধারণা করছেন। সত্যিই কি আত্মহত্যা কোনো রোগ। যদি রোগই হয়, তাহলে আমরা মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাই না কেন। লোকে কী বলবে—এ লজ্জায়-দ্বিধায়? আরে লোকে তো কত কথাই বলে, বলেছে, এমনকি ভবিষ্যতেও বলবে। লোকের কথা ভেবে নিজের ভালো থাকা, নিজের মতো করে আনন্দে বাঁচা থেকে কেন নিজেকে বঞ্চিত করব বলুন তো? যখন মনে হবে আমার সব শেষ, আমি বুঝি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি, ভেসে যাচ্ছি খড়কুটোর মতো অথবা মনে হবে আমার পায়ের তলা থেকে সবটুকু মাটি বোধ হয় সরে গেল আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম কিংবা মনে হতে পারে, যে মানুষটাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি, সমর্পণ করেছি সম্পূর্ণভাবে, অথচ এই মানুষটাই আজ এতটা অচেনা, কী লাভ তাহলে বেঁচে থেকে? তার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো, হয়তো বুঝবে আমি না থাকার শূন্যতা!
ভুল, ভীষণ ভুল ধারণা আপনার। যে আপনাকে কষ্ট দিতে পারে, একা করে যেতে পারে, আপনার না থাকা তাকে মোটেও ভোগাবে না; বরং সে বিচলিত না হয়ে মুক্তি খুঁজে পাবে। ঠকে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়। স্বপ্ন দেখুন, বাঁচতে শিখুন। নিজেকে এমন জায়গায় দাঁড় করান, যেন আপনার শূন্যতা নয়, আপনার অস্তিত্ব এই পৃথিবী অনুভব করে।
তাই আবার বলছি, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, এটা অভিমান, যার রং সুবোধ সরকারের ‘শাড়ী’ কবিতার সেই তেজপাতার মতো বড্ড ফ্যাকাশে-বিবর্ণ। একটা রংহীন জীবনের অর্থ মরে যাওয়া নয়; বরং ঘুরে দাঁড়ানো, নিজেকে কারও জন্য না বাঁচিয়ে নিজের জন্য বাঁচাটাই সবচেয়ে জরুরি।
তাই শ্রীজাত মতো বলতেই পারি...
দেখো আলোয় আলো আকাশ
দেখো আকাশ তারায় ভরা
দেখো যাওয়ার পথের পাশে
ছোটে হাওয়া পাগলপারা,
এত আনন্দ আয়োজন
সবই বৃথা আমায় ছাড়া...

*লেখক: রোজিনা রাখী, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected]