এখানে একজন মায়ের বুক মুড়মুড়িয়ে ভাঙে!
মাঘ ও ফাল্গুনে সব পাতা ঝরে গেলে সন্তোষপুরের পুরো রাবার বনাঞ্চল যেন দাঁড়িয়ে থাকে অস্থিমজ্জাহীন কঙ্কাল সার হয়ে। প্রায় ১ হাজার ২০০ একরের এই সরকারি রাবার বাগানের আশপাশের জমিতে প্রধান অর্থকারী ফসল হিসেবে চাষাবাদ করা হয় আনারস ও কলা। তাও মাঘ, ফাল্গুনে মাঠে কাজ কমে যাওয়ায় আজিরন বিবির মতো অনেক মায়েরা রাবার বাগানের শুকনা পাতা সুরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ শুকনা পাতা মহিষ বা ঘোড়ার গাড়িতে কিনে নিয়ে যান গেরস্তেরা। তাঁরা তাঁদের কচু, হলুদ, আনারস খেতের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন শুকনা পাতাগুলো। সারা দিন আজিরন বিবি রাবার বাগানের শুকনা পাতা সুরে ৩৫০ টাকা আয় করতে পারেন।
খুব অল্প বয়সে সন্তোষপুর গ্রামের দিনমজুর মফিজ মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় আজিরনের।
চালচুলোহীন ছাপরিতে অভাবের সংসার চালাতে সেই থেকেই অন্যের জমিতে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করে সংসারের হাল ধরেন আজিরন বিবি। স্বামী মফিজের ইচ্ছাতেই আট সন্তানের জন্ম দিলেও প্রসবকালীন নানান জটিলতায় মৃত্যু হয় তাঁর চার সন্তানের। এখন সংসারে চার সন্তানের জননী আজিরন। স্বামী–স্ত্রী মিলে ছয় সদস্যের ভরণপোষণের খরচ চালাতে হয় তাঁকেই। স্বামী মফিজ মিয়া অনেক দিন ধরে নানা শারীরিক অসুখে ভোগার কারণে এখন আর কাজ করতে না পারায় সংসার চলে আজিরন বিবির হাড়ভাঙা খাটুনির পয়সায়।
আকাশে মেঘ ডাকলেই চমকে ওঠেন আজিরন। ঘরে তাঁর অসুস্থ স্বামীসহ চার কন্যাসন্তান। একটু দমকা হাওয়ায় উড়ে যাবে তাঁর নড়বড়ে ছাউনির ঘর। এমন কতশত রাত ঘরে বসে বৃষ্টিতে ভিজে কাটাতে হয় তাঁর পরিবার নিয়ে সে খবর কেবল আজিরই জানেন। তবুও মা নিজের পরিবার ও সন্তানদের বুকে আগলে রাখতে শতকষ্ট সয়ে পাখির ছানার মতোই যেন নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখেন আজিরন।
অশ্রুসিক্ত আজিরন বলেন, ‘বুকটা চিড়া দেখাইতে পারি না আমার অন্তরার দুঃখ। এ হুকনা পাতার লাহান হুকাইয়া মচমচ করে আমার কইলজাডা, আমার ঘর নাই, পোলাপাইন লইয়া ভাঙা ঘরে থাহি, ঝড়, তুফানে মাইনসের বাড়িত আশ্রয় লই। সরকারের কোনো সহযোগিতা আমি আইজো পাইলাম না। পোলাপানগুলো নতুন জামাকাপড়ের লাইগাও কান্দে, অগরে চাইরআনা দিবার পাই আর কুলায় না। কাম করতে করতে দুইডা পা’ও অচল হয়া যাইতাছে, পা’য়ের বেদনা আর কুলায় না আমার।
হারা দিন রাবার বাগানো পাতা হুইরা যা পাই, তা–ই দিয়াই সদাইপাতি কইরা বাড়িত যাই। তাই কইছিলাম সরকার কিংবা কোনো একজন যদি আমারে থাহনের একটা ঘর কইরা দিত, আমি মইরাও শান্তি পাইতাম, পোলাপাইনগুলা থাহার একটা জায়গা পাইত।’
একসময় পৃথিবীর অন্যতম পাতা ঝরা বন মধুপুর গড়ের শালবনের একটি অংশ ছিল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার এ সন্তোষপুর বনাঞ্চল। পরবর্তী সময় বন খেকোদের আগ্রাসনে নির্বিচার কাটা হয় বৃক্ষরাজি, নিঃশেষ হতে থাকে বনাঞ্চল। পরে বনবিভাগ বনের গাছ বাঁচাতে গড়ে তুলে অংশীদার ভিত্তিতে বিদেশি গাছের সমারোহে গড়ে তোলা সামাজিক বনায়ন।
তৎকালীন সরকার লাভের আশায় গড়ে তুলে রাবার বাগান, যা সন্তোষপুর রাবার উন্নয়ন প্রকল্প নামে পরিচিত। চৈত্রের শেষ থেকে শুরু হয় নতুন পাতা গজানো, বৈশাখে গাছগুলো যেন চির যৌবনে ফিরে আসে, সবুজের জোছনায় মুখর হয় চারপাশ। পাতারা বুড়ো হয়, হলুদ হয়ে আবারও ঝরে পড়ে নির্বিকার। পাতাদের জীবন বদলায় অথচ জনমদুখিনী আজিরনের মতো মায়েদের জীবন বদলে যায় না কখনোই, দিন শেষে কেবল রাত যায় আজিরনদের।