ঈদের চাঁদ

নামাজের পর খুশিতে কোলাকুলি করছে দুই শিশু। ঈদের আনন্দ যেন ছোটদেরই বেশিফাইল ছবি

এখনো সূর্য ওঠেনি। আমি উঠে গেছি। আমার সঙ্গে দুয়েকটা পাখিও উঠে গেছে। একদম কুচকুচে কালো। দেখতে অবশ্য মন্দ নয়, কী সুন্দর চোখ। চোখের ভেতর মায়া। আমি বারান্দায় এলাম। আমাকে দেখে থেমে থেমে ডাকছে, কুহু কুহু!

মা বলেছিলেন, ভোরের হাওয়া গায়ে মাখতে হয়। প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে এদিক–সেদিক হাঁটতে হয়। তারপর না হয় ঘণ্টাখানেক ঘুমাবে। মা নেই। গত সপ্তাহে চলে গেছেন না–ফেরার দেশে। আচ্ছা, চলে গেলেন কেন তিনি? আমি কি খুব বেশি বড় হয়ে গেছি। আমার সব বন্ধুর মা-বাবা বেঁচে আছে। স্কুল ছুটি হলে গেটে দাঁড়িয়ে তারা অপেক্ষা করে। আমার তো কেউ নেই। কে অপেক্ষা করবে আমার জন্য।

সেদিন হয়েছে কি, আমার ক্লাসের এক সহপাঠী। কী যেন নাম তার? উঁহু, মনে করতে পারছি না। মা মারা যাওয়ার পর কিছু একটা আমার হয়েছে। শুধু ভুলে যাই। আমার এক স্যার তো ক্লাসে দাঁড় করিয়ে আমাকে ভীষণ লজ্জা দেন। তিনি বলেন, কী রে নাফিস, পড়া পারিস না কেন?

মাথায় নেটওয়ার্ক পায় না নাকি? হা হা। স্যারের হাসি দেখে ছাত্ররাও হাসে। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সে হয়তো কেঁদে ফেলত। আমার না কান্না আসে না। জগতের মানুষ, মানুষের রূপ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার বয়স আর কত হবে! এই ১৩ কিংবা ১৪। এতটুকু বয়সেই আমি পৃথিবীটা চিনে গেছি।

আমি এখন যে ঘরে থাকি, এটা আমার ঘর নয়। আমার বন্ধু নাবিলদের কাজের ছেলে রশিদ ভাইয়ের ঘর। বেচারা পালিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আমার কিছু টাকাপয়সাও নিয়ে গেছে। আমার দুঃখ লাগেনি। হয়তো তার খুব প্রয়োজন ছিল। আমার চেয়েও বেশি। আমার তো টাকাপয়সার খুব বেশি একটা প্রয়োজন নেই। দুঃখ লেগেছে তখন, যখন সে আমাকে না বলেই চলে গেছে। একটিবার বলে যেতে পারত। কত দিন আমরা একসঙ্গে ছিলাম! কোথায় গেছে কে জানে!

নাবিল আমার বন্ধু। নাবিলের মা–বাবা সবাই আমাকে স্নেহ করেন। বড্ড ভালোবাসেন। সেবার আমাকে আমার চাচারা বাড়ি থেকে বেধড়ক মারধর করে বের করে দিয়েছিলেন। তখন নাবিলের বাবা আমাকে এ বাড়িতে আশ্রয় দেন। নাফিস, তোমার যত দিন ইচ্ছা থাকবে, এটা তোমার নিজের বাড়ি মনে করবে।

নাবিলরা দ্বিতীয় তলায় থাকে। নাবিল আমাকে ওপর নেওয়ার জন্য কত কান্না করেছে কিন্তু ওর দাদু চায়নি যে আমি নাবিলের সঙ্গে থাকি। আমার এতেই হবে। যেখানে পৃথিবীটা আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে আমোদ ফুর্তিতে থাকা তো বিলাসিতা।

আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে। আগামীকাল ঈদ। নাবিলদের বাসার সবাই শপিংয়ে গেছে। নাবিল দরজার ওপাশ থেকে দুয়েকবার ডেকেছে। আমার শরীর ভালো। তবু বলেছি, শরীরটা ভালো নেই। গত রাতে একটু ঘুম হয়নি। এখন ঘুমাইলেই ঠিক হয়ে যাবে। তুই যা, আমি যেতে পারব না ভাই।

আমি তাদের সঙ্গে বাইরে যেতে চাচ্ছি না। তাদের সঙ্গে আমার যায় না। রাত হয়ে এল। ওরা সবাই ফিরতে দেরি করছে। নাবিলের দাদু রাজ্যের বাজারসদাই নিয়ে দ্রুতই ফিরে এসেছে। আমাকে কলপাড়ে হাত–মুখ ধুচ্ছিলাম। দ্বিতীয় তলার বারান্দা থেকে আমাকে ডাকলেন। আমি দৌড়ে গেলাম। আগে কখনো ডাকেননি। ভাবলাম, বাসায় কেউ নেই, হয়তো দাদুর জরুরি কোনো কাজে ডাকছেন আমায়।

দাদু আমাকে সবকিছু দেখাল আগ্রহ করে। আমার এতে বিন্দুমাত্রও আগ্রহ ছিল না। কে কী কিনল, কত দাম নিল। নাবিলের জামা তিনটা। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে পরবে একটা, পরে পরবে একটা। বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে গেলে পরবে আরেকটা। আমাকে এসব দেখার মানে কী। খুব অপমান করছে। আমি বুঝতে পারছি। দাদুমণি হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, আগামীকাল তো ঈদের দিন। আমাদের বাড়িতে প্রচুর মেহমান আসবে। তুমি কোথায় থাকবে, বলো? এক কাজ করতে পারো। ওরা বাইরে থেকে ফেরার আগেই তুমি চলে যাও। দুয়েক দিনের জন্য দূরে কোথাও ঘুরে আসো কেমন?’

দাদু জানেন, আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। তারপরও...

আমি মাথা নেড়ে হেসে চলে এলাম। যেন দাদু আমাকে খুব হাসির একটা গল্প শুনালেন।

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আকাশে কী সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা চাঁদ উঠেছে দেখে ছাদে কতো হইচই, আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে। অথচ আমি..!

আমার কাছে মনে হচ্ছে চাঁদটাকে আজ মনমরা মনমরা লাগছে। সবাই তাকে দেখে খুশিতে হাসছে আর সে আমাকে দেখে কাঁদছে। আমার জন্য কি চাঁদেরও মন খারাপ হচ্ছে?

খুব মায়া হচ্ছে আমার প্রতি তার। আমি কারও মায়াবন্ধনে থাকতে চাই না। আমি চলে যাব। দূরে কোথাও। যেখানে চাঁদের আলো নেই, মায়া নেই, ছায়া নেই। সেটা কোথায়? জানি না কোথায়। এখান থেকে চলে যেতে হবে, সেটাই জানি। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে নাবিলের জন্য। একটা চিঠি লিখে যাব? নাহ থাক, মায়া বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। সবাই ভালো থাকুক।