আমাদের বাবা

আমার বাবা শিক্ষক। দায়িত্ব ও কর্তব্য—দুটিকেই বাবা সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা তিন ভাইবোন। বাবা সারা দিন স্কুলে থাকতেন। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত। মাকে খুব কম সময় কাছে পেয়েছি। বাবা যেটুকু সময় পেতেন, আমাদের খেয়াল রাখতেন। যৌথ পরিবারে আমরা দাদু, দিদিমা, কাকু, কাকিমা, ছোট দুই ভাইসহ থাকতাম। সবার আদরে বেড়ে ওঠা। বাবা ব্যস্ত থাকার কারণে আমাদের তিন ভাইবোনকে স্কুলে আনা–নেওয়া করতেন কাকু। কাকু ছিলেন আমাদের পরিবারের সবকিছুই। কিন্তু আজ দাদু, দিদিমা, কাকু কেউ আর পৃথিবীতে নেই।

পরিবারের পুরো দায়িত্ব এখন বাবার ওপর। আর বাবার অনুপ্রেরণা হলো আমার বড় জেঠু। জেঠুর অবদান অনেক আমাদের জীবনে। বাবাকে শেষবার কাঁদতে দেখেছিলাম কাকু যেদিন পৃথিবী থেকে চলে যান। সবচেয়ে কাছের মানুষকে হারিয়ে বাবা পুরো ভেঙে পড়েছিলেন। অনেকটা বছর পর বাবা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।

বাবার স্বপ্ন ছিল একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার। তাই বাবা ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেননি। বেছে নিয়েছিলেন এক সাধারণ জীবন। শিক্ষক সম্মানটাই বাবার কাছে সেরা প্রাপ্তি ছিল। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজকের দিনটা।

ভালো লাগে এটা ভেবে যে বাবা শুধু আমাদের নয়, অনেক শিক্ষার্থীরও আদর্শ। একদিকে শিক্ষকতা পেশা, অন্যদিকে পরিবার কোথাও কোনো কমতি রাখেননি। আজ খুব মনে পড়ছে ছোটবেলাটা। আমি খুব ঘুমাতে পছন্দ করতাম। দিনরাত শুধু ঘুমাতাম। বাবার মোটরসাইকেলের শব্দ যখনই শুনতে পেতাম, উঠে পড়া শুরু করতাম। বাবা চিন্তা করতেন, এ মেয়ে কীভাবে মানুষ হবে। অবশ্য আজ আর চোখে ঘুম নেই আমার। সেটার জন্যও বাবার চিন্তা। বাবা স্কুল থেকে এসে যখন বাজারে যেতেন, আমারও ইচ্ছা হতো বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে বাজারে যেতে। কিন্তু বাবা কখনো সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইতেন না। তাই একটু বুদ্ধি করে শর্ষের তেল গায়ে মাখতাম। গরমে সেটা জ্বর হয়ে যেত। আর বাবা সেটাকে জ্বর ভেবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। এভাবেই বাবার সঙ্গে থাকা। সমাজের অনেকেই আমার গায়ের রং নিয়ে কথা বলেছিল, কিন্তু একজন মানুষ ছিল, যাঁর কাছে আমার গায়ের রং সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল। আমার গায়ের রংকে সমাজ সেদিন কী চোখে দেখেছিল জানি না; কিন্তু বাবার কাছে আমি অনন্যা ছিলাম।

ছোটবেলায় যখন আমাদের জ্বর হতো, বাবা সেটা বুঝতে পারলে খুব রেগে যেতেন আর কথা শোনাতেন। জ্বরটা যেন ইচ্ছা করেই বাঁধিয়েছি। অথচ বাবার জ্বর এলে সেটা দোষের হয় না। সেটা তখন সামান্য জ্বর হয়ে যায়। বাবাদের জ্বর সামান্য হয় কীভাবে—এ প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি। তবে এটুকু বুঝেছি, বাবারা সবচেয়ে বেশি ব্যথা পান সন্তানের অসুখে।

আমার একবার ভীষণ বড় অসুখ হয়েছিল। বাবা এক সপ্তাহ জেগে ছিলেন হাসপাতালে। আমাকে একটা নতুন সকাল দেখিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, বাবা নিজের জন্য অনেক কিছু পছন্দ করেও কিনতেন না দামটা একটু বেশি বলে। অথচ আমরা কিছু বায়না করলে বাবা সেটার দাম করতেন না। মুহূর্তেই সেটা কিনে দিতেন। অভাব কী, সেটা কখনো বুঝতে দেননি। বাবার অনেক শাসনে বড় হয়েছি। কিন্তু সে শাসনে ভালোবাসাও ছিল। বাবার মতো ভালো কেউ বাসে না। বাবা মানে শুধু ছেলেবেলা নয়, বাবা মানে বেঁচে থাকার প্রতিটি বেলা। বাবা আজও আমাদের হাত ধরে আছেন।

বাবা, তোমায় কখনো জড়িয়ে ধরে বলা হয়নি ‘অনেক ভালোবাসি তোমায় বাবা’। সব কষ্টকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করার মানুষটাই বাবা। বাবাকে কখনো কিছু দিতে পারিনি। বাবার স্বপ্ন ছিল, তাঁর সন্তানেরা যেন ভালো মানুষ হতে পারে। স্কুলে অনেক বাবাই তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। কিন্তু আমাদের বাবা বলতেন, নিজেদের পরিচয়ে বেড়ে ওঠো। সত্যকে ধারণ করে চলো। এ সত্যই তোমাদের সঠিক পথে চলতে শেখাবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, সুস্থ থাকুন পৃথিবীর সব বাবা।