কোভিড-১৯–পরবর্তী মন্দা কাটিয়ে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, বাংলাদেশও তা থেকে রেহাই পায়নি। প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে যে কয়টি বিষয় আলোচিত হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে মে, ২২ এ মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪২, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ; খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি এপ্রিল, ২২–এর তুলনায় ৩৩ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে মে, ২২ তে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, যা নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। গত কয়েক মাস ধরেই চাল, গম, মাছ-মাংস, ভোজ্যতেলের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার যদি আরও বৃদ্ধি পায় তাহলে জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করা হবে বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ববাজারে গমের চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকে রাশিয়া এবং ইউক্রেন। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতদিন বাংলাদেশ গম সংগ্রহ করে এসেছে মূলত ইউক্রেন, রাশিয়া এবং ভারত থেকে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে গম আনার পথ বন্ধ। আবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভারতে এবার গমের উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে ভারত আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ হয়ত তার চাহিদা অনুসারে ভারত থেকে গম আমদানি করতে পারবে না। আবার বাংলাদেশ মিউরেট অব পটাশ (এমপিও) সার আমদানি করে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে, যা যুদ্ধের কারণে বর্তমানে স্থগিত আছে। তাই সামনের বোরো মৌসুমে রবি শস্যের ফলনও উপযুক্ত পরিমাণে সারের অভাবে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক এ টালমাটাল অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়েছে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ বন্যা। চেরাপুঞ্জি ও আশপাশের এলাকায় অতিবৃষ্টির কারণে গত ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা হয়েছে এতদঞ্চলে। অন্য বছরের তুলনায় এবার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হার অনেক বেশি হবে। সম্প্রতি সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যার কারণে একদিকে যেমন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, আবার গুদামে রাখা মজুদ খাদ্য ভেসে গিয়ে পরিস্থিতি আরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলি সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এবার বেশি দামে হলেও খাবার পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সাম্প্রতিককালে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, অধিকন্তু আমদানি করতে হয় এমন কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে । গত মে মাসে আগের মাসের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। জ্বালানি তেলের দাম গত কয়েক মাস ধরেই ঊর্ধ্বমুখী।
অপরিশোধিত তেলের দাম গত ১২ মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ। জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে পণ্য পরিবহন ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। আর চলমান যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বেই শিল্প কাঁচামালের দাম অনেক বেড়েছে। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ ও তা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারকে অনেক বেশি কৌশলী হতে হবে। এই মুহূর্তে জিডিপির বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে সম্প্রসারণমূলক বাজেট প্রণয়ন করলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। এখন বিপন্ন মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই হোক মূল লক্ষ্য, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়। তাই আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রয়োজনে মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই ব্যয় সংকোচন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনার অভিঘাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিসহ, প্রান্তিক ও সর্বতোভাবে দরিদ্র বিপন্ন জনগোষ্ঠীর অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেই শুধু নয়, এসডিজির মূলমন্ত্রও ‘কাউকেই পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’ সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিসর বাড়াতে হবে। এটাই বাস্তব সত্য যে করোনা এবং সাম্প্রতিককালের বন্যা বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ন্যূনপক্ষে কোটির কাছাকাছি নিয়ে গেছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কৌশল হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির গতি চলমান রাখা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যাপ্তি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া—প্রয়োজনে সরাসরি নগদ অর্থ তাদের কাছে হস্তান্তর করা। সর্বোপরি, রাষ্ট্রের সব খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহে লাগাম টানা। বিলাসিতা করার জন্য সুদিন অবশ্যই আসবে—কিন্তু এখন সর্বাত্মক কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে রক্ষার প্রচেষ্টাই হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। যদি তা করতে পারি সেটাই হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। এটাই সত্য যে উন্নয়ন কোনো জিনিষের জন্য নয়, উন্নয়ন মানুষের জন্য এবং তা করতে হবে মানুষের হাত দিয়েই। শুধু সরকারের একক প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর না করে পরিস্থিতি মোকাবিলায় চাই সম্মিলিত উদ্যোগ।
লেখক: ড. মু. আব্দুর রহীম খান, সহযোগী অধ্যাপক, বিআইজিএম, শিরিন শারমিন, সহকারী অধ্যাপক, বিআইজিএম (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট)