অসমাপ্ত

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আফিয়া মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। আফিয়ার মা জাকিয়া বানু একজন সরকারি স্কুলশিক্ষক। আফিয়ার বাবা মারা গেছেন সাত বছর হলো। এই সাতটি বছর জাকিয়া বানু একাই তিন সন্তানকে লালন-পালন করেছেন। বর্তমানে আফিয়া টিউশনি করে সংসারে হাত বাড়িয়েছে।

আফিয়া ঢাবির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার বান্ধবী লিসা। লিসার বড় ভাই আদিব। আদিব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আদিব খুব গুছিয়ে কথা বলত। সে যখন কথা বলত সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত। আদিব প্রায়ই ইউনিভার্সিটিতে লিসাকে নিতে আসত। সেই থেকেই পরিচয়। ফেসবুকের মাধ্যমে দুজনের সম্পর্ক গভীর হলো। তাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো ইউনিভার্সিটি শেষে। একদিন টিউশন শেষে দেখা হলো আদিবের সঙ্গে। তার হাতে গোলাপ ফুল। আদিব তাকে রিকশায় তুলল। তারপর বলল,
‘ফুলটা খোঁপায় বেঁধে দিই?’
আফিয়া বলল, ‘না।’
‘কেন?’
‘এমনি’
‘এমনি? এমনি কোনো কারণ হলো?’
আফিয়া জবাব দেয়নি। হাওয়ায় আফিয়ার চুল উড়ছিল। আফিয়ার নিজেকে মনে হচ্ছিল মেঘের মতো, যেন সে-ও যাচ্ছে ঠিকানাবিহীন ভাসছে কল্পনার জগতে।
কয়েকটা দিন অস্থিরতায় দিন কাটল আফিয়ার। পারিবারিক অবস্থার ফলে দ্বিধায় ভুগছিল। আদিবের সঙ্গে যোগাযোগটাও কমিয়ে দিল। আবার পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।

আচমকা আদিবের বাড়িতে তার বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। মেয়ে দেখা শুরু হলো। আদিবের মা একটি মেয়েকে পছন্দও করলেন। তাই আদিব তার মাকে আফিয়ার কথা বলল। আদিবের মা আফিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। আদিব আফিয়াকে ক্যাফেতে দেখা করতে বলল। আফিয়া আদিবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। আদিব বিয়ের কথা বলতেই আফিয়া দিশেহারা বোধ করতে লাগল। আফিয়া এই পৃথিবীর বাস্তবতা এই ছোট্ট জীবনে বুঝে গিয়েছিল। সে জানে, শ্বশুরবাড়ি থেকে সবাই আর্থিক সহায়তা নিতে পারে, কিন্তু সবাই দিতে পারে না, এসব কথা সে আদিবকে বোঝাতে লাগল।
এসব কথা শুনে আদিব বলল, ‘আমি বাবা-মাকে রাজি করাব।’
আফিয়া বলল, ‘আমাকে মেনে নেওয়া সম্ভব কিন্তু আমার পরিবারকে নয়।’
‘তুমি দেখো, আমি সবাইকে রাজি করিয়ে ফেলব। কারও কোনো সমস্যা থাকবে না।’
‘তুমি না হয় সবাইকে বুঝিয়ে ফেলবা কিন্তু তোমাকে কে বোঝাবে।’
‘মানে?’
‘আজ তোমার মধ্যে আমাকে নিয়ে যেই অনূভুতি কাজ করছে, তা কিন্তু কিছু মাস বা বছর পর থাকবে না, তখন তোমার আমাকে এবং আমার পরিবারকে বোঝা মনে হবে।’
‘না, আফিয়া এমনটা কখনো হবে না। আমি সব সময় তোমাকে ভালোবাসব।’
মৃদু হেসে আফিয়া বলল, ‘থাকবে না আদিব। এই অনুভূতি, এ ভালোবাসা কিছুই থাকবে না।’

আদিব আফিয়াকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। আফিয়া কিছুতেই মানল না। সে আবার মৃদু হেসে বলল, ‘এ যে আমাকে এমন করে চাইছ, আমি চাই এই চাওয়াটা যেন সারা জীবন থাকে।’

আদিব বিভ্রান্ত বোধ করল। আফিয়া আবার বলল, ‘কয়েক মাস বা বছর পর আজকের এই মুহূর্তকে সবচেয়ে বাজে মুহূর্ত মনে হবে। এই অনুভূতিগুলো তখন মরে যাবে, ভালোবাসা তুচ্ছ মনে হবে।’

আফিয়া একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, ‘আমি চাই না এই ভালোবাসা, অনুভূতিগুলো হারিয়ে যাক। আমরা একে অপরের অনূভুতি হব অভ্যাস নয়। আজীবন অনুভূতি হয়ে একে অপরের মনের কোনো কোনায় থাকব।’
আদিব সেই দিন শেষবারের মতো আফিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল।

আদিব শেষবারের মতো আফিয়াকে তার ভালোবাসার কথা বলল এবং আরও বলল,
‘আফিয়া তুমি আজীবন আমার অনুভূতি হয়ে থাকবে।’
বাড়ি ফিরে আদিব তার মাকে বলল সে পারেনি তাকে (আফিয়া) ধরে রাখতে।

আফিয়া এখন ডাক্তার। তার মা এবং ভাইবোনগুলোর জন্য সব করে সে। পারিবারিক অসচ্ছলতাও কেটে গেছে। আদিবও বিয়ে করেছে, পরিবার হয়েছে তবু আজও আদিব আফিয়াকে মনে করে। আফিয়া আজও আদিবের অনুভূতি হয়ে আছে, হয়তো আদিবও আফিয়ার অনুভূতি হয়ে আছে।
সব ভালোবাসার পূর্ণতার প্রয়োজন হয় না।
কিছু গল্প অসমাপ্তই ভালো।

লেখক: ফারিহা খান, একাদশ, ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজ